না- মানুষের স্বপ্ন
কুশল মিশ্র
টুপটাপ নিভে গেল শহরের আলো। অমাবস্যার নিকস রাতে আমি। রাস্তা জুড়ে ঘেয়ো কুত্তার বিষাদ বেহাগ নিয়ে হাঁটি টলোমলো পায়ে। রাস্তা চেনায় বন্ধু শহর। গলির পর গলি। এলোমেলো সর্পিল পদচারনায় হাঁটতে থাকি সরীসৃপের মতো। সরে যায় বাড়ি, ল্যাম্পপোস্ট, রাস্তা, রাস্তার পাশে সারি দেওয়া গাঢ় লিপস্টিক। সারপেনটাইল লেন, ছাতুবাবুর বাজার, ত্রিপল চাপা বস্তির ধারে পা ছড়িয়ে খেলা করে উদোম খোকা। হাত দিয়ে ধুলো মেখে হাসে ফুটপাতের দেবশিশু। আমি চুপিচুপি হাঁটি। শিশুর মিলিটারি চোখ বিদ্ধ করে আমার নাগরিক ছলনা, কপট মুখোশ। কোনওভাবে মুখ ঢেকে পাশ কাটাই। অস্বস্তি ঢাকি। পাঞ্জাবি লরির তীব্র সার্চলাইট ধাঁধিয়ে ওঠে চোখ। এতো আলো, আলোতেও দমবন্ধ হয়। কোনওভাবে সেঁদিয়ে যাই পাশের চোরাগলিতে। অন্ধকারে। স্বস্তি আসে। আহাঃ কী আরাম। কী নিবিড় অন্ধকার। বুভুক্ষু সমাজের এই অন্ধকারই আমার সহজাত। আরশোলা, টিকটিকির মতো, আমিও অন্ধকার খুঁজি। সুড়ঙ্গ খুঁজি বেবুস্যে বুদ্ধিজীবীদের হাত থেকে রেহাই পেতে। তবু অমোঘ ওদের আগমন। অমোঘ ওদের উপদেশ। টিভি, সংবাদপত্র, রাস্তা, মিছিল, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, দিল্লি, কামদুনি, মমতা, বুদ্ধ, আমরা, ওরা সবেতেই লালার মত জড়িয়ে থাকে ওরা।
কামদুনি, খরজুনা, সুঁটিয়া প্রতিবাদে নামে। আন্দোলন হয়। রাস্তা ভরে নগর মিছিলে। কিন্তু কী হয় এতে? কারা শাস্তি পায়?লাশকাটা ঘরে দেহ খুঁড়ে চলে রঙ খোঁজার উত্সব। রঙ চাই, রঙ ভালো রঙ, হেঁকে যায় রাজনীতিওয়ালারা। আমরাও রঙ খুঁজি। রঙ না পেলে সে তো না মানুষের দলে। মানুষ পরিচয়টা বড্ড সেকেল। সে ছিল নীলদর্পণ, নবান্নের যুগে। উদ্বাস্তু মানুষের কাতারে কাতারে ভিড় শহরের ফুটপাতে। দুমুঠো ফ্যানেভাতের জন্য দোরে দোর ভিক্ষায় বেঁচে থাকা কঙ্কালের সারি। বলিষ্ঠ গলায় গান ওঠে শহরের তিনমাথায়। এসো মুক্ত কর, মুক্ত কর, অন্ধকারের এই দ্বার। দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ, সলিল চৌধুরীর দৃপ্ত কন্ঠে মানুষের গান।
মানুষ কনসেপ্টটা হারিয়ে গেল। আইডিন্টিটি ক্রাইসিসে শতছিন্ন মোরালিটি। মানি ম্যাটার নয়, ভ্যালুসটারে রাইখো, কতকাল আগে গমগমে গলায় কাঁধে হাত রেখে বলেছিল পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা আইডিন্টিটি ক্রাইসিসের এক লড়াকু সৈনিক। দেশভাগ, ভিটে ছাড়ার যন্ত্রণা, কোনওভাবেই আইডিন্টিটি কাড়তে পারেনি চোয়াল শক্ত, মেরুদণ্ডী মানুষগুলোর। তারা লড়াই করে গেছে আমরণ। ছেঁড়া তক্তপোশে বসেই দিনবদলের স্বপ্নে জীবন কুরবান। বেহিসেবি টাকা ছিল না সে জীবনে, প্রভূত বিলাস ছিল না, ছিল না এলসিডি টিভি, লোনে নেওয়া গাড়ি, বাড়ি, এসি,ডানলোপিলোর গদি। কিচ্ছু ছিল না। মানি ব্যাগে টাকা ছিল না, জমি ছিল না, বাড়ি ছিল না, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ছিল না, কর্পোরেট সুখ ছিল না, সাজানো আতলামি ছিল না।
কী ছিল সেই হতচ্ছাড়া, হতদরিদ্র জীবনে? সম্বল বলতে শুধু এক কঠিন নীতিবোধ, ধ্রুবতারার মতো উদ্ভাসিত আদর্শ, বেপরোয়া সাহস, দৃপ্ত বিবেক, হার না মানা গোঁয়ার মন। এসবই ছিল গরীবের সম্বল।
চোখে চালসে পড়া বাবার চোখে আজও সেই স্বপ্ন। হাঁটতে পারেন না ভালো। নিবু নিবু চোখ। কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যালে চোখে আজও স্বপ্ন দেখেন আমার বোকা বাবা। আজও স্বপ্ন দেখেন দিনবদলের। চারপাশের নষ্টামি দেখে তেড়ে গালগাল দেন নেতা, মন্ত্রীদের। জঙ ধরা স্মৃতি খুবলে উঠে আসে সাতচল্লিশ, আটচল্লিশ, বাহাত্তর, যুক্তফ্রন্ট সরকার। চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসে এক অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়। তারপর সময়ের টিকটিক, ধীরে ধীরে কমে আসে চোখের জ্যোতি। চশমা খুলে ঘষা কাঁচে শান দেন বাবা। চোখে অশ্রুনদী।