শুধু দেখো আর খুশি হও মনে...
নিজের ছবি নিজে তুলুন, যত খুশি, যেমন ইচ্ছে, বাঁকিয়ে, চুরিয়ে, উল্টে, পাল্টে, সোজা করে উল্টো করে, মুখ চুপসে, মুখ ফুলিয়ে, কেঁদে কেটে, হামাগুড়ি দিয়ে, শীর্ষাসনে, বজ্রাসনে, শবাসনে। না তবু এর তালিকা শেষ হচ্ছে না। আরও আছে অনেক রকমভাবে নিজেকে সাজিয়ে তোলা তা নিয়ে রিসার্চ সেল বসছে। চলছে নিরন্তর গবেষণা। হাঁফিয়ে উঠছেন বিশেষজ্ঞরা। হেঃ হেঃ এ যাতা জিনিস নয়, সেলফি বলে কথা। এর কী কোনও শেষ আছে? ছোট গল্পের সংজ্ঞার মত, শেষ হয়েও হইল না শেষ। সেলফি কারাগারে ছটপট অবস্থা টিন টুইনস থেকে হাম্পু, বুড়ো, হোমড়া, চোমড়া সবারই। বিশ্বজুড়ে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
সেলফি কারে কয়?
উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। এ এমন এক বিষয় যা নিরন্তর পর্যবেক্ষণের, মনে হবে যেন পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীনও পথ, তবু পথের শেষ নাই। সেলফি তপস্যার গভীরে যে সাধকগন নিমজ্জিত তাঁরা বলছেন, ভয় নেই, ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই, নাই নাই ভয় হবে হবে জয়। তাই জয় মা বলে সেলফি গাঙে তরী ভাসিয়ে এগিয়ে চলো। উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত, প্রাপ্য বরান নিবোধত, ওঠো, জাগো, তোমার প্রাপ্য তুমি বুঝে নাও। সত্যিই তো চেতনার গভীর থেকে কে কবে এমন কথা বলেছে, মার্কস বাদ, লেনিন বাদ, গান্ধী বাদ, চেচেন বাদ, গোরিলা বাদ, জঙ্গিবাদ সব ঝুটা হ্যায়। কলিতে একমাত্র মোক্ষের পথ সেলফি বাদ। চাচা আপন প্রান বাঁচা। শুধু নিজেকে নিয়েই থাক, নিজেকে নিয়েই ভাব, নিজের সঙ্গে আত্মরতির এই গভীর দর্শনইতো উত্তর আধুনিক সেলফি সময়ের ইস্তেহার।
সেলফি দিয়ে যায় চেনা
আপনি কেমন আছেন, সেলফি বলবে। কেমন চলছে সংসার সেলফি বলবে। এবার মেনি কটা বাচ্চা দিল, সেলফি বলবে। গোঁফ ছিল সজারু, কী করে হাঁসজারু হল তাও সেই সেলফিই বলবে। সেলফি বলবে আপনার দাম্পত্য, আপনার চার দেওয়াল, আপনার ভালবাসা, আদুরে স্ত্রী কখন বরের হ্যাঙার হন, তাও সেলফিই জানিয়ে দেবে। সেলফি জানিয়ে দেবে মিরিকে বেড়াতে গিয়ে কখন আপনার প্রকৃতির ডাক এসেছিল, সেলফি জানিয়ে দেবে আপনার অন্তরবাস, সহবাস সবকিছু। সেলফির থেকে তবুও প্রত্যাশা অনেক। সেলফি প্রত্যাশার মোহিনী জাল ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্ববীনায়, বিশ্বজনে, স্থলে, জলে, নভোতলে, বনে, উপবনে, নদী, নরে, গিরি, গুহা পারাবারে।
সেলফি vs সেলফি
চুল তার কবেকার, অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখে তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, বনলতার মুখোমুখি বনলতা। সে নিজেকে দেখে, আরও দেখে, অনেক রকম ভাবে দেখে, নিজেকে ছেড়ে মন অন্য কোথাও এখন এর যেতে চায় না। নিজের ভূবনে কাউকে এখন আর ঢুকতে দিতেও ইচ্ছে করে না। রুপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কী হবে তোমার?? যদি কেউ না দেখে আর? ছয়ের দশকের রোমান্টিক গান ফাস্টু খেয়ে লটকে পড়ে। তবু নিজেকে দেখা শেষ হয় না। রাস্তার পাশে থুড়থুড়ে মুখে গ্যাঁজলা ওঠা বুড়ো, তোমার ডাকে সাড়া দিতে বয়েই গেছে। চোখের সামনে পাশের বাড়ির কিশোরীর শ্লীলতাহানি, বয়েই গেছে। এতো পাশের বাড়ি, রাস্তার কথা। ঘরের ভেতর বাবার হুপিং কাশিটা বেড়েছে, মুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে উঠছে রক্ত, বয়েই গেছে। মায়ের চোখে ঝাপসা, ছানি পড়ছে, সুগার, প্রেশার, দুর ভাল্লাগে না। এসব নিয়ে পড়ে থাকলে নিজেকে দেখব কখন? দূর হঠাও হিউম্যানিসম।
সেলফি যুগের পর....
সমস্ত দিনের শেষে সন্ধ্যা নামে। জীবনের লেনদেন নেই। খুব ঠান্ডা, দিন কমে আসছে, রাত বাড়ছে, সূর্যের আলোও নাকি কমে যাবে। বাতাসে বাড়বে বরফের গুঁড়ো। কার্বন, নাইট্রোজেন, মিথেন আরও কত গ্যাস। ব্ল্যাক হোলে ডটকম হয়েছে দুনিয়া। সেলফির সেল্ফ-ম্যাডরা মাস্ক পরে নিয়েছে। নতুন যুগের মোকাবিলায় তৈরি তারা। কিন্তু আয়নার কী দাগ লাগিছে, ঝাপসা কাঁচে ছবি ওঠে না ক্যান? সেলফির ক্যানভাস কালো কেন?কেন আর দেখা যাচ্ছে না নিজেকে? কেন? কেন? কেন? সেলফি রিসার্চ উইংসে ঘন ঘন ফোন, টুইট। সেলফি সভ্যতায় কী ঘনিয়ে আসছে বিপদ? প্রশ্ন, প্রশ্ন। যত প্রশ্ন তত প্রতিধ্বনি। শেষে উত্তর আসে। আলো ছাড়া ছবি ওঠে না। তোমায় প্রতিফলিত করবে কে? হে ছায়াবৃতা। তাই তো সেলফি ঘোমটার নীচে অপরিচিত তোমার মানব রুপ। উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।