মিছিল... মৃত্যু... বেহালা
আজ যদি চেতনার মাঝে পড়ে আছে লাশ... বহুদিন আগের লেখা একটি লাইন আবারও ধাক্কা মেরে গেল। একটু অন্য পরিসরে। নিউ গড়িয়ার, ঢালুয়া গমকল মোড় আমাদের সবাইকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সামনে অসংখ্য প্রশ্নমালা। ডাইনে মোরাম বিছানো হতবাক্ সরুগলি। সুদীপ্তর বাড়ির রাস্তা। রাস্তার শেষপ্রান্তে সুদীপ্তদের বাড়ি 'সরগম'। সেখানে প্রায় প্রলাপের মত জেগে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। অভ্যাস, অস্বস্তি আর হাপড় টেনে বেঁচে থাকতে চেয়ে বেহালায় ছর টানছেন। স্বরলিপি লেখা কাগজগুলো মাঝে মধ্যেই এলোমেলো হয়ে পড়ছে। যেভাবে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটের পর থেকে সবটাই যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে এই চৌষট্টি বছরের অশক্ত মানুষটির। প্রলাপ। একমাত্র প্রলাপ বলাটাই প্রণব কুমার গুপ্তের সঙ্গে এখন মানায়। সদ্যপ্রয়াত ছেলের কথা বলতে বলতেই বলছেন, "ভায়োলিনটাই এখন আঁকড়ে ধরতে চাইছি, আচ্ছা কী মনে হয় বলুন তো, আবার বাজাতে পারবো তো?" প্রলাপের মত বলে চলা, জলজ্যান্ত প্রলাপের মতই তিনতলা বাড়িটার ওপর নিচ হাতড়ে বেড়ানো। এই সিঁড়িগুলোর বাঁকে যদি একবার দেখা হয়ে যায় তার তেইশ বছরের হারিয়ে যাওয়া ছেলেটার সঙ্গে। তাইতো কথা বলতে বলতেই হঠাত্ বলে উঠছেন, "একটু দাঁড়ান আসছি।" আলো আঁধারিতে সিঁড়ি ভাঙছেন সুদীপ্ত গুপ্তর বাবা। যেভাবে জীবনর এতগুলো সিঁড়িগুলো পেরিয়ে এসে হঠাত্ই যেন ওঁর মনে হচ্ছে সব সিঁড়িই কেমন যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। বেহালার কাছে ফিরতে চাইছেন প্রণববাবু। পালিয়ে যেতে চাইছেন। পালিয়ে যাওয়ার যে কোনও সিঁড়ি নেই সামনে।
আজ যদি চেতনার মাঝে পড়ে আছে লাশ...
বহুদিন আগের লেখা একটি লাইন আবারও ধাক্কা মেরে গেল। একটু অন্য পরিসরে। নিউ গড়িয়ার, ঢালুয়া গমকল মোড় আমাদের সবাইকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সামনে অসংখ্য প্রশ্নমালা। ডাইনে মোরাম বিছানো হতবাক্ সরুগলি। সুদীপ্তর বাড়ির রাস্তা। রাস্তার শেষপ্রান্তে সুদীপ্তদের বাড়ি 'সরগম'। সেখানে প্রায় প্রলাপের মত জেগে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। অভ্যাস, অস্বস্তি আর হাপড় টেনে বেঁচে থাকতে চেয়ে বেহালায় ছর টানছেন। স্বরলিপি লেখা কাগজগুলো মাঝে মধ্যেই এলোমেলো হয়ে পড়ছে। যেভাবে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটের পর থেকে সবটাই যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে এই চৌষট্টি বছরের অশক্ত মানুষটির। প্রলাপ। একমাত্র প্রলাপ বলাটাই প্রণব কুমার গুপ্তের সঙ্গে এখন মানায়। সদ্যপ্রয়াত ছেলের কথা বলতে বলতেই বলছেন, "ভায়োলিনটাই এখন আঁকড়ে ধরতে চাইছি, আচ্ছা কী মনে হয় বলুন তো, আবার বাজাতে পারবো তো?" প্রলাপের মত বলে চলা, জলজ্যান্ত প্রলাপের মতই তিনতলা বাড়িটার ওপর নিচ হাতড়ে বেড়ানো। এই সিঁড়িগুলোর বাঁকে যদি একবার দেখা হয়ে যায় তার তেইশ বছরের হারিয়ে যাওয়া ছেলেটার সঙ্গে। তাইতো কথা বলতে বলতেই হঠাত্ বলে উঠছেন, "একটু দাঁড়ান আসছি।" আলো আঁধারিতে সিঁড়ি ভাঙছেন সুদীপ্ত গুপ্তর বাবা। যেভাবে জীবনর এতগুলো সিঁড়িগুলো পেরিয়ে এসে হঠাত্ই যেন ওঁর মনে হচ্ছে সব সিঁড়িই কেমন যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। বেহালার কাছে ফিরতে চাইছেন প্রণববাবু। পালিয়ে যেতে চাইছেন। পালিয়ে যাওয়ার যে কোনও সিঁড়ি নেই সামনে।
শোকও মুখর হয়ে ওঠে স্লোগানে স্লোগানে। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে তরতাজা যৌবনগুলি। ল্যাম্পপোস্টে টাঙানো চওড়া ফ্লেক্সের এক কোনে সুদীপ্ত গুপ্তর স্বপ্নমাখা দুচোখ। যে চোখ আর সূর্যোদয় দেখবে না। পাশে লেখা 'অমর রহে।' যন্ত্রনাক্লিষ্ট নিথর মুখটায় মুখ রাখছেন বাবা। বুকের কাছে দু'হাত জরো করছেন। ক্ষমা চেয়ে নিলেন বোধহয়! রাজনীতির পাঠ শেষে প্রতিদিন গভীর রাতে ফেরার জন্য ছেলেকে কড়া ধমকগুলোর কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে কি প্রণববাবুর? আপাত নিরীহ রাস্তা জুড়ে তখন স্লোগান আর স্লোগান। সুদীপ্তর নিথর শরীর নিয়ে আবেগের স্রোত বয়ে যাচ্ছে মিছিলে মিছিলে।
তারপর ভিড় ক্রমেই হালকা হয়ে গেল। সুদীপ্ত গুপ্তর বাড়ির সামনে কয়েকটি সমবয়সী ছেলের জটলা। কয়েক হাত দূরেই তস্যগলিতে এক আইসক্রিম বিক্রেতা। ঠিক দেখছি তো? এগিয়ে গিয়ে দেখি হ্যাঁ, হুবুহু, একদম ঠিকই তো। বাণিজ্য কি আর আবেগ মানে? বাজারের কাছে কিইবা জন্ম, কিইবা মৃত্যু। আসল কথা হল মাছের ঝাঁকের মত একপাল মানুষ। ওই ভিড়েই আছে ক্রেতা, আছে ভোটার, আছে টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টি. আর. পি)।
তারপর যেভাবে বিকেল নামে। ঠিক সেভাবেই গড়িয়ে গড়িয়ে বিকেল নামল গমকল মোড়ে। কিছুক্ষণ আগেই আবেগের স্রোতে ভেসে গেছে এই রাস্তা। চারিদিকের পরিবেশে এখনও কান্নার ভেজাভাব। যদিও আবার একটু একটু করেই গতানুগতিকতায় ফিরছে অধূনা বিখ্যাত এই মোড়টি। মোড়ের মাথায় জনাকয় বৃদ্ধের গল্পগাছা, অবশ্যই সুদীপ্তর কথা ফিরে ফিরে আসছে ওদের সংলাপে। পাশে একটি 'ডান্সস্কুলে' সালসা, হিপহপ, ওয়েস্টার্ন শেখানো হয়। জনাকয় ছাত্রী এসে জুটেছে। কিছুক্ষণ পর কানে হেডফোন গুঁজে এলেন ওদের ট্রেনার। না, শেষমেশ বিশ্রী কাণ্ডটা ঘটলো না। মিউজিক বাজলো না 'ডান্সস্কুলে'। তার পাশের বাড়িতে এক সাধারণ গৃহবধূ অকাতরে মিছিলে আসা সবাইকে জল খাওয়াচ্ছিলেন। এখন তার ঘরের ভিতর থেকে নিউজ চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজের ঝলক শোনা যাচ্ছে। সুদীপ্তদের কটা বাড়ি পরে একটি পেল্লাই বাড়ি। নেমপ্লেট-এ লেখা 'মিত্র।' এক ভদ্রমহিলা ছোট্ট শিশু কোলে আরেক মহিলার সঙ্গে গল্প করছেন। বাচ্চাটার চোখমুখ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। মোরাম বিছানো রাস্তাটায় একটা বাচ্চা তার দাদার সঙ্গে মিলে সাইকেল চালানোর চেষ্টা করছে। সুদীপ্তর লাশ নিয়ে মিছিল ততক্ষণে এস.এফ.আই রাজ্য কমিটির দফতরে পৌঁছেছে। সুদীপ্তদের বাড়ির ঢিলছোঁড়া দূরত্বে বড় রাস্তার পাশে দোকানগুলো খুলছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে কিছুটা কম হলেও ভিড় রয়েছে দোকানগুলোয়। ফাস্টফুডের দোকানে সমবয়সী মানুষের জটলা। স্বাভাবিক কথাবার্তা। অভ্যাসে বাঁধা জীবনে মৃত্যুও কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেছে। আলাদা করে যেন আর আলোড়িত করে না। আইন অমান্য আন্দোলন করতে গেছে, পুলিসের মারে ল্যাম্পপোস্টে মাথা থেঁতলে এক ছাত্র মরেছে। ভেরি স্যাড। কিন্তু এমনটাতো হতেই পারে, আগেও ইতিহাসে কত হয়েছে। সব কেমন যেন গা সওয়া ভাব। সিপিএম-এর হাতে তৃণমূল মরবে, কিংবা তৃণমূলের হাতে সিপিএম-এমনটাতো হয়ই। কিংবা পুলিসের গুলিতে মাওবাদী, বা মাওবাদীদের গুলিতে পুলিস, ঠিক এভাবেই পুলিসের মারে আন্দোলনকারীর মৃত্যু-হতেই পারে। দিনের শেষে এসবই কেমন যেন গা সওয়া হয়ে গেল।
একটা দেশ ছায়ার যুদ্ধ রত/শত শিবির বানালো... সুতরাং রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের পাহারাদার পুলিস বনাম বেপরোয়া বিরোধী রাজনীতিক। রাষ্ট্রের 'ফোর্স' বনাম রাষ্ট্র বিরোধী মাওবাদী। সিপিএম বনাম তৃণমূল... আর দেশ? দেশটাতো আসলে ভূগোল বই-এর পাতায় জেগে আছে। আমার ব্যলকনি ঘেষে আমার জাগ্রত পৃথিবীতে, চারপাশতো আসলে চারপাশেই জেগে থাকে। দরজা বন্ধ করে নিলেই হল। ওসব শিবির-টিবির-এ ঢোকায় কি কাজ বাপু। তার চেয়ে দর্শক বনে গেলেই হয়! ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াও। জায়ান্ট স্ক্রিন-এ গোটা দেশ। কত মেলা। অমন কত লাশ, কত মিছিল, সবই রাজনীতির ব্যাপার-রাজাটাজাদের ব্যাপার-তার মাঝখানে পড়ে সাধারণ ছেলেগুলো বেমক্কা মরে গেল-সত্যিই খুব খারাপ লাগছে গো। একটু চা বসাও গিন্নি। মনটা হালকা করা দরকার। একটু টিভিটা ছাড়োতো।
সব গা সওয়া হয়ে গেছে। যেভাবে গা সওয়া হয়ে গেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। বিভিন্ন ঘটনায় তার অবাক করা মন্তব্যগুলিও। জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলির মুখোমুখি হয়ে পুলিসি হেফাজতে সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যু নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বলে ওঠেন 'ছোট ঘটনা' তখনও আলোড়ন হয় না মনে। এসবও কেমন গা সওয়া হয়ে গেছে। পার্কস্ট্রিট কাণ্ড, কাটোয়ার ধর্ষণকাণ্ড, এসবইতো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ছোট ঘটনা; সাজানো ঘটনা বলে মনে হয়েছিল। সত্যি রাজনীতির কঠিন পাঠ কখনও মনের স্বাভাবিক ছন্দ কি নষ্ট করে দেয় নাকি? না হলে সবকিছুর অন্তরালেই রাজনীতির অভিসন্ধি দেখেন কী করে একটা মানুষ? রাজনীতির অভিসন্ধি মানেই তো বিরোধীদের চক্রান্ত, 'সাজানো ঘটনা', ফন্দিফিকির, সুতরাং ছোট ঘটনা, তুচ্ছ ঘটনা। এর কোনও উত্তর আছে কি? উত্তর নেই। যেমন চারপাশে ঘটে চলা অনেক কিছুরই উত্তর মেলে না। যেমন এই প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পাইনি, যে সুদীপ্ত গুপ্তর মত একটা তরতাজা প্রাণ ঝরে পড়ার পরও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ, ছাত্র পরিষদ, ডিএসও সহ নানারঙের সংগঠন, নাগরিকদের ছোট বড় নানা মঞ্চ কেন শোকমিছিলে শোকমিছিলে মহানগরে বান ডাকলো না। কেন কেউ চিত্কার করে বলল না সুদীপ্ত, তুমি আমার ভাই, এই রাজপথে তোমার রক্ত লেগে আছে। একজন ছাত্র হিসেবে, সহনাগরিক হিসেবে, এই পথে হাঁটতে আমার কষ্ট হচ্ছে। বুক ভেঙে যাচ্ছে। বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে। বন্ধু, তুমি নেই। আজ সব রঙের পতাকাগুলো অর্ধনমিত। আজ সব ছাত্র সংগঠনের শোকদিবস। কারণ, এক ছাত্রের রক্ত পড়ে আছে শহরের রাজপথে।
দূর... এসব আবার হয় নাকি? যত সব বক্ওয়াজ!