ঋতু যায়, পর্ণ ঝরে, ঋতু আসে
-লিঙ্কটা কোথায় পাঠালে, পেলাম না তো ভাই?...-পাঠিয়েছি ঋতুদা। মেলটা একবার ভালভাবে চেক করুন।-আমার ব্ল্যাকবেরি থেকে শুধু ছবি দেখা যাচ্ছে গো। লেখাটা আইপ্যাড থেকে দেখে নিয়ে তোমাকে জানাচ্ছি, কেমন?চিত্রাঙ্গদা ফিল্মের রিভিউ লিখেছিলাম আমাদের ওয়েবসাইটে। তার পর দিনই মেলবক্স খুলতেই প্রথম মেলটা ওঁর।
-লিঙ্কটা কোথায় পাঠালে, পেলাম না তো ভাই?...
-পাঠিয়েছি ঋতুদা। মেলটা একবার ভালভাবে চেক করুন।
-আমার ব্ল্যাকবেরি থেকে শুধু ছবি দেখা যাচ্ছে গো। লেখাটা আইপ্যাড থেকে দেখে নিয়ে তোমাকে জানাচ্ছি, কেমন?
চিত্রাঙ্গদা ফিল্মের রিভিউ লিখেছিলাম আমাদের ওয়েবসাইটে। তার পর দিনই মেলবক্স খুলতেই প্রথম মেলটা ওঁর।
"পড়লাম। বড় যত্ন করে লিখেছ ভাই। ধন্যবাদ দিচ্ছি না। এর পর থেকে শুধু আমার সিনেমা নয়, অন্য ছবি রিভিউ করে নিজের ভাল লাগলে আমার কাছে পাঠিও। আমি পড়ব। ভালোবাসা, ঋতুদা"
ভাল লিখলে, ভুল বললাম, 'নিজের লিখে ভাল লাগলে' ২৪ ঘণ্টা ওয়েবসাইটের লিঙ্কটি পাঠিয়ে দেওয়ার মোলায়েম নির্দেশ ছিল তাঁর। সেটাই করতাম। ভারতবর্ষের খুব কম পরিচালকই অনামী কলমের ফিল্ম সমালোচনা পড়তে আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেই স্বল্প, মৃতপ্রায় গোষ্ঠির মধ্যে তিনিও ছিলেন।
তবুও কেমন যেন মেনটেন করে চলতাম সম্ভ্রমের দূরত্ব। ফিল্মের প্রিমিয়ার অথবা পার্টিতে দেখা হলেই প্রশস্ত হাসি। একদিকের কাঁধ চেপে ধরে বলতেন, কেমন আছিস রে ফুলকলি! শুধুমাত্র সেই সময়ে তুমি থেকে তুই-তে।
এরই মধ্যে কাগজ-টিভি-পত্র-পত্রিকায় অপূর্ব সব লেখা বেরিয়েছে। মন দিয়ে পড়ে দেখেছি, সেই বিস্তৃতিতে যোগ করার মতো তেমন বহুমূল্য কিছু আমার কাছে নেই। তবে একটা কথা, বাস্তব জীবনে আর সাংবাদিকতায় আপন করে নেওয়ার টেকনিকটা আবিষ্কার করেছিলেন ঋতুদাই। আগে যে সম্বোধন ছিল সম্ভ্রমের "আপনি', সেটাই হয়ে গেল অনায়াস "তুমি"। "তুমি" এক ধাপ নেমে এসে দাঁড়াল "তুই"-এর শিয়রে। যেন যান্ত্রিক করমর্দনের বদলে আলিঙ্গন। অর্থোডক্স বাঙালির ভ্রু এমনিই কুঁচকে গেল। কারও কারও কুঁচকেই রইল। কারওর আবার প্রথম ধাক্কা কেটে যেতেই বেশ সাগ্রহ অনুমোদন পেল এই সম্বোধনের শব্দবন্ধ। কারণ, তাঁর ঝুলি থেকে তখন বেরিয়েছে অননুকরণীয় কলম আর কিছু অনবদ্য ছবি। ইতিহাস যেগুলিকে অচিরেই আলিঙ্গন করে নেবে...
আবেগের কী ঋতুরঙ্গ থাকে? গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত্, হেমন্ত? জুলাই মাসে রাজেশ খন্না যেদিন চলে গেলেন সেদিনও আকাশের চোখে জল। ঋতু প্রয়াণের দিনে এই ভর মে মাসেও আকাশে ভর করে এত মেঘ এল কী ভাবে! যে-ঘুম তাঁকে নিয়ে গেল ঘুমের দেশে, সে পথও কেমন করে উপচে উঠল বিষাদবারিতে?
আমাদের প্রফেশনে আবেগের দাম নেই। বাঁধ আছে। খরার সমস্যা দেখা দিলে আবেগ ছাড়া হয় যতটুক না হলে নয়। সেটুকুও দেখতে পাবেন লেখার পাতে কিংবা বড়জোর পিটুসিতে চলকে পড়া দুয়েকটা শব্দে। আমার সিনিয়রের এক সন্দিগ্ধ টেলিফোন পাওয়ার পরে খোঁজ লাগাই। বিহ্বল, মূহ্যমান হয়ে যখন খবরটা শুনে অফিসে দিই মোবাইলে। তখন কয়েকটা বিস্ময়বোধক শব্দ আছড়ে পড়ে ওদিক থেকে-
-এত বড় খবরটা ভেরিফাই না করে দেওয়া যাবে না তো। তুমি আরও শিওর হয়ে বল।
শ্রবণেন্দ্রিয়ের ওপর বিশ্বাস রেখেই আরও একবার বলি ব্রেকিং দিতে। বাকিটা আমি ওঁর বাড়িতে যাওয়ার পর..
-সে বললে কী হয়! ততোধিক অবিশ্বাসের সুর ও প্রান্ত থেকে, এত বড় নিউজটা ব্রেকিং দিয়ে গুজব হলে বিপদে পড়ব। আরও খোঁজ নাও।
-দায়িত্ব নিয়েই বলছি, দিয়ে দিন।
তা সত্ত্বেও, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মিশ্র দোলাচলে ব্রেকিং দিতে দিতেই পড়শি চ্যানেলের থেকে কয়েক সেকেন্ড পিছিয়ে পড়লাম। অ্যাঙ্কর কী প্রশ্ন করলেন ওপার থেকে জানি না। প্রতিনিধি হিসেবে আমার নামটা শুনে সংবিত্ ফিরল। বলতে গিয়ে বুঝলাম, সব ইন্দ্রিয় অসাড় হয়ে গিয়েছে। বার বার দেখা ঋতুদার সব ছবিই জট পাকিয়ে দলা হয়ে আছে গলায়...
*****
ঋতুদার প্রিয়, অতিপ্রিয় মানুষগুলির ভিড় পেরিয়ে তাসের ঘর-এর অন্তরমহলে ঢুকলাম। দুধসাদা চাদরের অন্দরে এক শরীর শুয়ে আছে। এ শরীর নিয়েই ঈশ্বরের সঙ্গে নাকি তাঁর যুদ্ধ ছিল! তাঁর ধারণা ছিল তিনি জিতবেনই। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার সংবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। জানা নেই, শোনা কথা...সেইজন্যেই নাকি প্রতিশোধও নিল প্রকৃতি, শরীরের উপর দিয়েই! এমনই শুনেছি, ক্ষুধা কমিয়েছিলেন পাকস্থলীর ঘের কমিয়ে। সে সব প্রশ্নের উত্তরে এখন মৌনতা ছাড়া কিছুই প্রাপ্য নয়। যিনি অপরের শরীর ও মস্তিষ্কে ঢুকে এমন সুনিপুণ হাতে বের করে আনতেন অভিনয়ের নির্যাস, কবিগুরুর সবকটি রচনার শরীরে ডুবসাঁতার দিয়েও তুলে আনতে পারতেন সবচেয়ে সেরা মুক্তোটি, যেকোনও কলমের শরীর থেকেই অনায়াসে গেঁথে ফেলতেন একটি ছবি। সেই তিনি কেমন করে পারলেন নিজের প্রতি এমন নির্মম হতে? কী অসুখ হয়েছিল তাঁর? কী 'অসুখ'?
সাবেকি সেগুনকাঠের খাটে কালো বার্নিশ। পাশাপাশি একটিও শব্দ নেই ক্রন্দন ছাড়া। গলার দলা পাকানো কষ্টটা আস্তে আস্তে খুলছে। আলগা হতে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখি চারপাশে বৃত্ত হয়ে আছে উনিশে এপ্রিল-দহন-তিতলি-শুভ মহরত্-চোখের বালি-আরেকটি প্রেমের গল্প-চিত্রাঙ্গদা-নৌকাডুবিরা। সব কলাকুশলীর সমবেত অশ্রু-উত্সবে। কপালে, মুখে হাত বোলাচ্ছেন ঋতুপর্ণা। আকুল হয়ে যেভাবে কাঁদছেন প্রসেনজিত্ চট্টোপাধ্যায়, তার বাংলা ভাষায় সঠিক প্রতিশব্দ নেই। সান্ত্বনার অনেক ঊর্ধ্বে। পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন দেবশ্রী রায়। এক মাতৃসমা অভিনেত্রী চন্দনের বিন্দু দিয়ে সাজিয়ে দিলেন শান্ত-সমাহিত মুখশ্রী। সঙ্গে ঋতুপর্ণাও। সাজানো হল রাজবেশে। সখী হম মোহন অভিসারে যাউঁ...
আবিষ্কার করি এক নায়িকা মাথা রেখেছেন আমার কাঁধে। অশ্রুবারিজলে ভিজে যাচ্ছে কাঁধ। তাঁর জীবনের প্রথম জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি আবহমান-এ। পাশে দাঁড়িয়ে আরও দুজন নায়িকা। শোকার্ত মুখ। ঋতুদার কোনও ছবিতে একবার সুযোগের অপেক্ষা আর পূরণ হবে না কোনওদিনই। আছেন দীর্ঘদিনের সাংবাদিক বন্ধুমহল। সুবোধ শিষ্যকুল। একান্ত আপনজন।
সাংবাদিক জীবনের এক দশকে কোনওদিনও সুযোগই হয়নি এত বর্ণময় একটি চরিত্রের সাক্ষাত্কার নেওয়ার। কেরিয়ারের অর্ধদশক কাটিয়েছি যে পত্রিকায়, সেখানে তিনিই ছিলেন সম্পাদকের আসনে। ভাগ্য এমনই বিশ্বাসঘাতক, আমার আসার দেড় বছর আগেই পদে ইস্তফা দিয়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তবু ছেড়ে-যাওয়া পত্রিকাও ফলো করতেন নিয়মিত। তাই প্রথমবার আলাপ করতে গিয়েই টের পেয়েছিলাম, আমার পদবিটাও জানেন তিনি! ব্যোমকেশ ছবির শুটিং শুরুর দিকে নাছোড়বান্দা হয়েছিলাম একখানি ইন্টারভিউয়ের জন্য। এসএমএস এল, 'ভাল নেই গো।'
আরও একটু অনুরোধের পর জবাব,
'গত কাল থেকেই শরীরটা বড় অসুস্থ। মনে হয় পেরে উঠব না।'
সেযাত্রাও হল না। তাক করে ছিলাম ব্যোমকেশের শুটিং শেষ হওয়ার পর...
প্রায়ই এমন অসুস্থতার খবর পেতাম ওঁর সহকারীর কাছ থেকে। বলত সে, আপনি ভুল বুঝবেন না। দাদা সত্যিই সকাল থেকে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। এই বিকেলে স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসেছেন সবার সঙ্গে। কালও একই করেছেন। আপনি কাল একবার খোঁজ নিন না, দিদি..
সে শরীর আর কথা রাখল না! ঋতুদা ছবি বানাতেন না। নারীর মনে তুলি ডুবিয়ে ছবি আঁকতেন। উনিশে এপ্রিল থেকে চিত্রাঙ্গদা পর্যন্ত তিনি সেই ক্যানভাসটাই শেষ করে গেলেন। নিজের মতো করে। আঠেরোটা ছবির বারোটা জাতীয় পুরস্কার। দেশবিদেশের স্বীকৃতি। ছবিগুলো নিয়ে অনেক কথা বলতে নিশপিশ করছে আঙুলের ডগা। এ লেখায় সেটা নাহয় তোলাই থাকল।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর ঝাপসা দৃষ্টির মধ্যেই কাঁচবাক্সে তোলা হয়ে গাড়িতে। তোলা হল বহু কষ্টে। বাইরে মিডিয়ার সমাগমে ধাক্কাধাক্কি। আজকাল বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মৃত্যু মানেই রাজনৈতিক মৃত্যু। পুলিস আর রাজনৈতিক দলের স্নেহধন্যদের অসংযত, অনাবশ্যক প্রহরা। অগণিত লোকসমাগম যাঁরা হয়ত এই ক্ষণজন্মা পরিচালকের নামই শুনলেন প্রথমবার। দেখলাম, এমন শোকস্তব্ধের ভিড় যাঁরা একের পর এক পর্দার তারকাকে দেখলেই সিটি-তালি সহকারে উল্লাস প্রকাশ করছেন। সমুদ্রের মতো এগিয়ে আসছেন তাঁদের দুধসাদা গাড়ির দিকে। ঋতুদার মরদেহ অতি সাবধানে তোলার প্রবল চেষ্টা হচ্ছে গাড়িতে। মিডিয়ার ক্যামেরাবদ্ধ হচ্ছে তাঁর মহাপ্রস্থানের পথের প্রতি মুহূর্ত। শ্রদ্ধার নামে মোবাইলবদ্ধ হচ্ছে প্রয়াত কিংবদন্তির মুখ। এবার নন্দনের উদ্দেশ্যে রওনা হল গাড়ি...
আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেই অপূর্ব শটটা। কাঁচবাক্স থেকে একটুও শব্দ না করে বেরিয়ে এলেন সুসজ্জিত ঋতুপর্ণ। ভিড় সরে গেল পদ্মপাতায় জলের মতো। জড়ো হওয়া টেকনিশিয়ানরা হইচই করে অসামান্য দ্রুততায় সাজিয়ে ফেলল ক্যামেরা ট্রলি, লাইটস, রিফ্লেকটর। ত্বরিত্গতিতে সাজানো হল সেট। ভিড় থেকে এগিয়ে এলেন জনৈক পরিচালক। ক্যামেরার সামনে এক ক্যামেরাম্যানও।
সায়লেন্স। রোল ক্যামেরা। রোল সাউন্ড। অ্যাকশন।
এবার সময় মুখোমুখি বসিবার... ইতি এবং ঋতুপর্ণ।