রূপকথার রাজা রোনাল্ডোর গল্প যেভাবে বুড়ো বয়সে নাতিদের কাছে করবেন
স্বরূপ দত্ত
প্রথমেই বলে নিই, এটা কোনও নিরপেক্ষ লেখা নয়। এটা রোনাল্ডো বন্দনা। এই লেখা শুধুই রোনাল্ডোপ্রেমীদের উত্সর্গ করা। তা বলে কী রোনাল্ডো ভক্ত নন, তাঁরা এই লেখাটা পড়তে পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। তবে, মাথায় রাখবেন, এই লেখাটা রোনাল্ডো সমর্থকদের উদ্দেশ্য করে লেখা। আজ রোনাল্ডোর দিন। তাই কিছু বন্দনা তো হবেই চ্যাম্পিয়নকে নিয়ে। তাই শুরু করলাম, রোনাল্ডোর পাঁচালি। আরও দুটো কথা আগে বলে নিয়ে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু রোনাল্ডো হলে, মেসি ঠিক চলে আসবেনই। একটা কথা রোনাল্ডো ভক্তদের মতো করে বলে নেওয়া ভালো। আলোচনায় ওইসব 'ভদ্র' ছেলেকে খুব একটা গুরুত্ব দিলাম না। কারণ, রোনাল্ডোর চরিত্র বিতর্কিত বলেই কলকাতায় থেকে পর্তুগালের মানুষটাকে নিয়ে ভাবি। আলোচনা করি। লিখি। আমি ভদ্রলোক ফুটবলারকে নিয়ে করবটা কী? মেয়ের বিয়ে তো দেব না! আজ থেকে প্রায় ২৫-৩০ বছর পর যখন আপনি বুড়ো হয়ে যাবেন, তখন নাতি-নাতনিদের রোনাল্ডো সম্পর্কে যে গল্পগুলো বলবেন, সেগুলো এরকমই হবে বোধহয়- তাই এবার শুরু রোনাল্ডোর ৭ রূপকথা!
১) রবিবার রাতে ম্যাচের ১৬-১৭ মিনিট। পায়ে হাত দিয়ে শুয়ে পড়লেন রোনাল্ডো। প্রথমে মুখটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। তারপরই চোখে জল! ওরকম ডাকাবুকো মানুষটার চোখে জল! বেরিয়ে এলেন মাঠ থেকে দুজনের কাঁধে চেপে। ফের বরফ ঘসে চলে গেলেন মাঠে। কিন্তু আর পারলেন না ওই খোঁড়া পা নিয়ে দৌড়তে। স্ট্রেচারে করে হাইহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়লেন। চোখদুটো দেখেই বুঝছিলাম, ট্রফিটা জিততে ঠিক কতটা চাইছিলেন রোনাল্ডো। হাফ টাইমে মাঠে এলেন। তারপর যেভাবে তাতালেন পেপে, প্যাট্রিসিওদের, নেতা কাকে বলে, বুঝছিলাম। এমন নেতার দল তো শেষ পর্যন্ত কোনও না কোনও সময় শেষ হাসি হাসবেই। তাই ম্যাচ জেতার পরও আধ ঘণ্টা ধরে মাঠেই চলল রোনাল্ডো সেলিব্রেশন। জিতেছে একটা দেশ। কিন্তু মাঠ, গ্যালারি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, গোটা বিশ্বে একটাই নাম। রোনাল্ডো! পর্তুগাল দেশটাও রোনাল্ডো নামের কাছে লিলিপুট। ক্যারিশমা এটাই। মনে রাখবো। বুঝবো, স্টার হয়টা কী!
২) তাঁর চিরকালের প্রতিদ্বন্দ্বী মেসি এবারের কোপাতেই হেরে গিয়ে অবসর নিলেন মাত্র ২৯-এ।তিনি রোনাল্ডো ৩১-এ পরের মাসেই জিতলেন ইউরো কাপ! কোপা আমেরিকা তো বটেই, কেউ কেউ বলেন, বিশ্বকাপ জেতাও ইউরো কাপের থেকে জেতা কঠিন। কথাটায় খুব ভুল নেই কিন্তু। এখানে লড়াই সেয়ানে সেয়ানে। তাঁর দেশ মেসির মতো ফুটবল কুলীন নয়। তাঁর দেশে যাঁরাই এসেছেন, তাঁরাই 'ফুটবলের সুখেন দাস' মার্কা পারফর্ম করেছেন! সবাই 'হেরো হিরো'! সে ইউসেবিও থেকে ফিগো কিংবা রুই কোস্তা। রোনাল্ডো বোঝালেন হিরো আবার হেরো হয় নাকি! তাই ২০০৪ থেকে চেষ্টা চালিয়ে পাক্কা এক যুগ পরে ফুটবল দেবতাকে ধ্যানে তুষ্ট করে বর নিয়েই ছাড়লেন! এবার মেসির থেকে অনেক কদম এগিয়ে থাকবেন রোনাল্ডো। একটা লাইনেই সব্বাই চুপ। রোনাল্ডোর অধিনায়কত্বে প্রথমবার ইউরো কাপ জিতেছিল পর্তুগাল! মেসির দেশ দুবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কিন্তু মেসির নিজের কী আছে? রোনাল্ডো এবার মেসিকে বলতে পারবেন দিওয়ারের স্টাইলে, 'মেরে পাস ইউরো কাপ হ্যায়!'
৩) রবিবার আর যা শেখালেন রোনাল্ডো। দল প্রথমবার ইউরো কাপ জিতেছে। তিনি দেশের সর্বকালের সুপার হিরো। ট্রফি তাঁর হাতেই সবথেকে বেশিবার ঘুরলো। নানা মেজাজে। কখনও খালি গায়ে সুঠাম শরীর দেখিয়ে। কখনও জাতীয় পতাকা টাওয়ালের মতো করে পরে। কখনও সাদা চ্যাম্পিয়নের জার্সিতে আবার কখনও পর্তুগালের চিরাচরিত জার্সিতে। ট্রফি দেওয়ার ঠিক আগে কোচ স্যান্টোসের পশ্চাদদেশে যেভাবে টোকা মেরে লজ্জা ভেঙে দিয়ে সবাই মাথায় তুলে নিলেন গুরুকে, জাস্ট দেখার মতো। আরও ভালো লাগলো, কোচ স্যান্টোসকে পাঠালেন সবার আগে পদক নিতে। তারপর সবাইকে দাঁড় করালেন লাইনে। আর নিজে সবার শেষে! হিরোইজমের নতুন উদাহরণ হয়ে থাকলেন অবশ্যই। তিনি জানেন, তিনিই বেস্ট। কিন্তু গুরুকে কীভাবে সেরা সাফল্যের দিনেও এগিয়ে দিতে হয় সবার সামনে, কীভাবে তুলে ধরতে হয় মাথার উপর, নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়ে গেলেন রোনাল্ডো।
৪) পায়ে যন্ত্রণা। ম্যাচের প্রথম ২৫ মিনিটেই উঠে যেতে হয়েছে মাঠ থেকে। খানিকটা সময় ড্রেসিংরুমে চলে গেলেন। সেখানে পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধলেন। তারপর বীরের মতো চলে এলেন হাফটাইমে মাঠে। দলের সব ফুটবলারকে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করে গেলেন, ওটা দেখার মতো। ফুটবল মাঠে দুঙ্গার পর আর এক ক্যাপ্টেনকে দেখা গেল, যিনি ক্যাপ্টেন শব্দটা শুধু বোঝেন না, নিজেকে তৈরি করেন না। তিনি ক্যাপ্টেন হয়ে জন্মেছেন। যিনি জন্মেছেন ক্যাপ্টেন হয়ে, তাঁকে ঘষামাজা করে বড় হওয়া ক্যাপ্টেনরা হারাবে কীভাবে! অবুঝ ঘষামাজা করে ক্যাপ্টেন হতে চাওয়া মানুষদের এসব বুঝিয়েও বলা যাবে না। তাঁদের বোঝার বাইরেই হবে। ঠিক যেমন রোনাল্ডোকে দেখলাম এক অন্য ভূমিকায়। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে পুরো ম্যাচ দলের কোচ স্যান্টোসের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের দলের ফুটবলারদের নির্দেশ দিয়ে গেলেন। তখন বোঝার উপায় নেই আসল কোচ কে? রোনাল্ডো নাকি স্যান্টোস? মারাদোনা-বিলার্দোর পর ফুটবলে আর কখনও কোচ-ক্যাপ্টেনের এমন দুর্দান্ত শোলের জয়-বীরু মার্কা যুগলবন্দি দেখেনি। সাবাস্ রোনাল্ডো!
৫) এবার এলো চরিত্রের প্রসঙ্গ। যদি কারও চরিত্র রঙিন না হয়, আমি অন্তত তেমন মানুষকে নিয়ে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করতে রাজি নই। আরে মশাই, আমার জীবনে আমার নিজেকে নিয়ে ছাড়া ভাবারই সময় নেই। সেখানে কাউকে নিয়ে যদি সময় নষ্ট করতেই হয়, সেই লোকটার চরিত্রও আমার আলোচনার বিষয়বস্তুর মানের হতে হবে। মেসিকে নিয়ে কথা বলেন যাঁরা, তাঁদেরকে সবসময় বলতে শুনেছি, যে মেসির মতো ভদ্রলোক হয় না। আচ্ছা বলুন তো, মেসির মতো ভদ্রলোককে নিয়ে আমি করবটা কী? মেয়ের বিয়ে দেব নাকি! গোটা পৃথিবী চিরকাল সন্তানের বাবার নাম জানতে পারার জন্য কী না কী করেছে। সেখানে, একটা 'সিংহ'কে দেখলাম। লোকটা নিজের সন্তানকে কাছে রেখে বড় করছেন। অথচ, গোটা পৃথিবী জানে না, তাঁর সন্তানের মায়ের নাম কী! এই চরিত্র হওয়াটা কতটা কঠিন, তার প্রমাণ পেতে হলে আপনাকে বুঝতে হবে, এরকম উদাহরণ আপনার কাছে একটাও আর আছে কী! রোনাল্ডো এরকমই। স্পেশাল। গোটা বিশ্বের সেন্টিমেন্টের হিসেবটাই বদলে দিয়েছিলেন। বাবার নাম জিজ্ঞেস করবে মানে? 'আমি তোর বাবা, মায়ের আবার দরকার কী!' কুর্নিশ। একেবারে উল্টোপথে চলে, এরকম একটা পথ দেখানোর জন্য। ভালো করে খতিয়ে ভেবে দেখবেন, রোনাল্ডোর এই মডেলটাও অনুসরণ করলে আগামিদিনে শিশুমৃত্যুর হার কমবে।
৬) তিনি রোনাল্ডো যদি ফুটবলার হিসেবে আলোচনায় আসেন, তাহলে তাঁর হয়ে কী বলবেন? কিসে পিছিয়ে তিনি? ক্লাব ফুটবলে হেন ট্রফি নেই, যা তাঁর জেতা হয়নি। বিশ্বের সর্বকালের দুই সেরা ক্লাবে খেললেন ১৪ বছর। একটা ম্যান ইউ তো পরেরটা রিয়েল মাদ্রিদ। ফিফার বর্ষসেরা ট্রফি তিনিও কম জেতেননি। মেসির মতো ৫ টা নয়। সে তো মারাদোনা, পেলেও ৫ বার বর্ষসেরা ফুটবলার হননি! তাতে কী তাঁরাও চিরকাল মেসির পরে থাকবেন নাকি! বরং, রোনাল্ডো আজ তাঁর দেশকে নিজের হাতে করে কুলীন করলেন। যা কেউ করেননি। সেটা নিজে প্রথম করলেন। আর দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ, আমি রোনাল্ডো। 'আসলে তাঁর অ্যাটিটিউডই রাজকীয়। আইসল্যান্ডের ফুটবলারের সঙ্গে জার্সি বদলে তাঁর হবেটা কী? তাঁর জার্সির দামটা ওই আইসল্যান্ডের ফুটবলার জম্মে বুঝতে পারতেন না, যদি একবার চাইতেই পেয়ে যেতেন। সেরাদের একটু অহং হয়। আপনি মানতে পারলেন না, তাতে ভারি বয়েই গেল। পৃথিবী সেরাদের চিরকাল মনে রাখে। ভদ্রলোকদের মনে রাখে না। কারণ, ভদ্রলোক জন্মায় আকছার। সেরা জন্মান কম-কম করে, অনেক বছর পরে।
৭) সবশেষে যেগুলো বলার। তাঁর ট্যুইটারে ফলোয়ারের সংখ্যা গোটা পৃথিবীর অন্তত শখানেক দেশকে জনসংখ্যার বিচারে পিছনে ফেলে দেবেন। তাঁর রোজগার, বিশ্বের বহু ব্যাঙ্কের মোট আমানতের পরিমাণের থেকে বেশি। তাঁর যত মহিলা ভক্ত আছে পৃথিবীতে, অত মহিলা অনেক দেশে থাকেনই না। তাঁর চুলের স্টাইল, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নকল করে যত মানুষ, ততজন টম ক্রুজ, মেল গিবসন, কেনু রিভসদেরও করে কিনা আজকের দিনে সন্দেহর বিষয়! তিনি এত কিছু। আর তিনি আপনার সামনে মাটির মানুষ হয়ে বসে থাকবেন? চাহিদাও মাইরি সকলের। আরে লোকটার বুকে দু-চারটে আগ্নেয়গিরি। সামান্য মুখ থেকে একটু লাভা উঠলো নাকি উঠলো না, ব্যাস, সবাই বলতে লাগলো, ইস এ কী মানুষ! হাঃ হাঃ, ওদের কে বোঝাবে, বুকের আগ্নেয়গিরিতে যে তুমি এতক্ষণে ঝলসে যাওনি তোমার ভাগ্য ভালো। মেসির বড় হওয়া লা মাসিয়ার দুর্দান্ত সিস্টেমের মধ্যে সংযতভাবে। রোনাল্ডো বড় হয়েছেন দ্বীপে, বালির চড়ায় ফুটবল খেলে। মেসি যখন বার্সায় শুরু করছেন, তখন দলে প্রবাদপ্রতিম রোনাল্ডিনহো। তাই মেসি মোটেই গায়ে ১০ নম্বর চাপিয়ে শুরু করেননি। রোনাল্ডো কিন্তু জীবনের প্রথম ম্যাচই শুরু করেছেন ম্যান ইউয়ের ৭ নম্বরে। ডেভিড বেকহ্যামকে এক ম্যাচে মলিন স্মৃতি করে দিয়েছিলেন। রোনাল্ডো রাজার রূপকথার গল্প বলতে দেখবেন বুড়ো বয়সে কী ভালো লাগবে। ওই যে শেষে একটা কথা বলার। অনেকেই ভালো। অনেকেই সেরা। কিন্তু রূপকথা সবাইকে নিয়ে তৈরি হয় না। রুপকথার রাজারা গল্পের রসদগুলো দিয়ে যান। ১০ জুলাইতে, ৭ নম্বরের রোনাল্ডো দেশকে ইউরো কাপটা জিতিয়ে বলে গেলেন হয়তো মনে মনে, 'বুঝলে মেসি, ১০ তারিখটাই বেছে নিলাম, জীবনের সেরা সাফল্যের দিনটা উপভোগ করার জন্য। আগের তিনটে ইউরো কাপ জিতলে এতটা আনন্দ পেতাম না, যতটা তোমার ছেড়ে দেওয়া কোপার সময় ইউরো কাপটা জিতে পেলাম। আর এবার তো আবার ১০০ বছরের কোপা। ১০০ বারই মনে করতে হবে রূপকথার রাজা রোনাল্ডোকে!'