দ্বিতীয় পুরুষ: শেষ বেলায় ঝটকা, ধরা পড়েও অধরাই রয়ে গেল খোকা
রণিতা গোস্বামী
রণিতা গোস্বামী
''ওগো বন্ধু সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধরিল মোরে / ফেলি তার জাল, তুলে নিল দ্রুতরথে দু'সাহসী ভ্রমনের পথে / তোমো হতে বহু দূরে, অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম/... ফিরিবার পথ নাহি, দূর হতে দেখো চাহি/ পারিবে না চিনিতে আমায়, হে বন্ধু বিদায়...'' শেষের কবিতার এই লাইনগুলি আওড়াতে আওড়াতে '২২ শ্রাবণ'এ নিজের জীবনের ইতি নিজেই টেনেছিলেন পুলিস অফিসার প্রবীর রায় চৌধুরী। মৃত্যুর আগে স্থির চিত্তে একদিকে প্রবীর রায় চৌধুরী (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) যখন শেষের কবিতা পাঠ করে যাচ্ছেন, অপরদিকে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় অভিজিৎ পাকরাশি শেষটা ঠিক কী হতে চলেছে তা বুঝেই তাঁর Sir-কে কাকুতি মিনতি করছিলেন। 'করবেন না কিন্তু প্রবীর দা এটা'। আজ থেকে ঠিক ৯ বছর আগে '২২ শ্রাবণ'-এর শেষটা এভাবেই করেছিলেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় (Srijit Mukherji)।
২০১১ থেকে ২০২০। ৯ বছর পর 'দ্বিতীয় পুরুষ'এ (Dwitiyo Purush) এসে বদলে গিয়েছে অনেককিছুই। তবে তারপরেও মূল ছাঁচটা কিন্তু প্রায় আদ্যোপান্ত একই রেখে দিয়েছেন পরিচালক। ২২ 'শ্রাবণ' ছবিতে পুলিস অফিসার প্রবীর রায় চৌধুরী বিদায় নিয়েছিলেন ঠিকই, তবে তিনি তাঁর ছাপ খানিকটা 'বংশবিস্তার'-এর মতোই 'দ্বিতীয় পুরুষ'এও রেখে গিয়েছেন। বলা ভালো, নতুন মোড়কে পুরনো মালমশলার অনেকটাই অক্ষত রেখেছেন পরিচালক। তবে এমনটা ঠিক কী কারণে বলছি, তা অবশ্য ছবি না দেখলে কোনও ভাবেই টের পাওয়া সম্ভব নয়।
ছবিতে অভিজিৎ পাকরাশি আগের থেকে অনেক বেশি পরিণত, বলা ভালো কালের চাকার বদলে তিনি তাঁর Sir প্রবীর রায় চৌধুরীর শিক্ষা মেনেই নিজেকে তুখোড় ও দৃঢ় পুলিস অফিসার হিসাবে তৈরি করেছেন। 'সিরিয়াল কিলার'দের ধরতে তিনি সিদ্ধহস্ত। সেকথা মাথায় রেখেই কুখ্যাত দুষ্কৃতী খোকাকে ধরতে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানেও সহকারি হিসাবে অভিজিৎ পেয়ে যান রজতকে (গৌরব চক্রবর্তী)। যাঁকে কিনা 'Serial Killer'-এর পাঠ পড়িয়েছেন অভিজিৎ।
ট্যাংরা এলাকায় চায়না টাউনের অলিতে গলিতে পুলিসের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই কৈশোর কেটেছে খোকার (ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়)। ছেলেবেলা থেকেই সে কুখ্যাত, অপরাধী গ্যাংয়ের মাথা। একের পর এক নৃশংস খুন শুধু নয়, খুনের পর নিজের Signature style-এ মৃতদেহের কপালে সে 'খোকা' নামটি খোদাই করে দেয়। সেই খোকা অবশেষে পুলিসের ফাঁদে ধরা পড়ে। জেলের লকআপে পুলিসের মার খেয়ে মরতে মরতেও শেষযাত্রায় সে বেঁচেই যায়। জীবনের ২৫ বছরটা জেলেই কেটেছে, তারপর সেই খোকা যখন ছাড়া পায়, সে যেন আরও ভয়ঙ্কর। কোনও একটি গোপন উদ্দেশ্যে খোকার সেই Signature style-এ আবারও একের পর এক খুন। তবে খোকার (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) খুনের মোটিভ ঠিক কী? খোকা কি সত্যিই Serial Killer? এ প্রশ্নের উত্তর বুঝতে গেলে অবশ্যই দর্শককে ছবির শেষ অবধি বসে দেখতে হবে। পুলিস অফিসার খোকাকে পাকড়াও করার জন্য অভিজিৎ পাকরাশি নিয়োগ হলেও গোটা ছবিতে অপরাধীর সঙ্গে তাঁর একবারও দেখা হয়নি।
২২ শ্রাবণ-এর মত এই ছবিতেও একের পর এক নৃশংস খুন। রহস্য়, খুনের সঙ্গেও এই ছবিতে বেশ কয়েকটি প্রেমের গল্পও রয়েছে। '২২ শ্রাবণ'-এর অভিজিৎ (পরমব্রত)-এর Live In Partner অমৃতা (রাইমা) এখানে তাঁর স্ত্রী। তাঁদের বিবাহিত জীবনে যদিও বিশেষ ঠিক ঠাক চলছে না। আপনাদের যদি '২২ শ্রাবণ'-এর দৃশ্যগুলি মনে আছে কি? সেখানে পুলিস আফিসার প্রবীর রায় চৌধুরী (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) অমৃতাকে ডাল-ভাত আর বিরিয়ানি-র পার্থক্যটা বোঝার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিরিয়ানির থেকে ডাল-ভাত যে বেশি প্রয়োজন, সে পাঠও প্রবীর রায় চৌধুরী এক ঝলক দেখাতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অমৃতাকে। 'দ্বিতীয় পুরুষ' (Dwitiyo Purush) ছবিতে অমৃতা (রাইমা) তাঁর ডাল-ভাতকে অভিজিৎ (পরমব্রত)-কে বিয়ে করেছেন ঠিকই, তবে বিয়ের পর তাঁদের প্রেমও কেমন যেন ভাল-ভাতের মতোই পানসে। আর তারই ফাঁকে ক্ষণিকের জন্য ঢুকে পড়ে তাঁর বিরিয়ানি সূর্য সিনহা (আবির চট্টোপাধ্যায়)। অন্যদিকে জুনিয়ার পুলিস অফিসার গৌরব চক্রবর্তীর সঙ্গে ঋদ্ধিমা ঘোষের প্রেম ও বিয়ে দুটোই বেশ সহজ ভাবেই এগিয়েছে। তবে এই দুই প্রেমের গল্প ঠিক কোন দিকে এগোবে তাও আগে থেকে জেনে গেলে হয়তবা তাল কেটে যায়। তবে এই ছবি আরও একটি ভালোবাসার কথা বলেছে, তবে সে প্রেমটা হলে না গিয়ে দেখলে ঠিক জমে না।
'২২ শ্রাবণ'-এর মতোই টান টান চিত্রনাট্য 'দ্বিতীয় পুরুষ' (Dwitiyo Purush) ছবির মূল রসদ। থ্রিলার বানানোর ক্ষেত্রে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মুন্সিয়ানা এই যে তিনি দর্শকদের শেষপর্যন্ত হলে বসিয়ে রাখতে জানেন। তবে দর্শকদের মনে কয়েকটি জায়গায় যেন একটু খটকা থেকেই যায়। যেমন 'সিরিয়াল কিলার' ধরতে পটু পুলিস আফিসার অভিজিৎ পাকরাশি পরও পরপর তিনটে খুন আটকাতে পারেননি। এই জায়গাটা শুধুমাত্র ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর জন্যই যেন ঘটানো হয়েছে বলে মনে হয়েছে। আরও একটি দৃশ্যে পুলিস লকআপের মধ্যে এতবড় আইওয়াশ হয়ে গেল আর তাঁর আঁচ এত বছরেও কেউ পাননি। এটা যেন শুধুমাত্র গল্পের তাল মেলানোর জন্যই ঘটানো। তবে দু-একটা বিষয় নিয়ে মনটা খুঁত খুঁত করলেও পুরো চিত্রনাট্য যে পরিচালক যথেষ্ট রিসার্চ করেছেন তা ছবির সংলাপ, তথ্যতেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
অভিনয়ের কথা যদি বলতে হয় তাহলে এই ছবিতে একে অপরকে টক্কর দিয়েছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য। অনির্বাণের গা ঘিন ঘিনে লুকটার জন্যই হয়তবা চরিত্রটি আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। একইভাবে অভিনয়ের জন্য প্রশংসা প্রাপ্য ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়ের। ছোট্ট চরিত্র হলেও নজর কেড়েছেন বাবুল সুপ্রিয়র চরিত্রটি। রাইমা, গৌরব, ঋদ্ধিমাও নিজ নিজ ভূমিকায় পারফেক্ট। যদিও এই ছবিতে তাঁদের বিশেষ কিছুই করার পরিসর ছিল না। সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্বে সৌমিক হালদারের ক্যামেরার কারিকুরি ও সম্পাদনার দায়িত্বে প্রণয় দাশগুপ্ত ছবির শেষ অবধি টানটান উত্তেজনা ধরে রাখতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের করা ছবির ব্যাক গ্রাউন্ড স্কোর ছবিটিকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। সবকথা বলা হলেও এই কথা না বললে অনেককিছুই অসম্পূর্ণ, তা হল ছবির মিউজিক। বরাবরের মতোই এই ছবিতে অনুপম রায়ের সুরে অনবদ্য অরিজিৎ সিং, ইমন চক্রবর্তী ও রূপম ইসলাম।
পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় ২০১১ সালে '২২ শ্রাবণ' বানিয়ে বাংলা সিনেমায় থ্রিলার হিসাবে মাইলস্টোন তৈরি করেছিলেন। তাই 'দ্বিতীয় পুরুষ' দেখতে দেখতে দর্শক খুব স্বাভাবিক ভাবেই '২২ শ্রাবণ' (Baishe Srabon)-এর সঙ্গে এর তুলনা টানবেনই টানবেন। তবে 'দ্বিতীয় পুরুষ'-এর যে ইলেকট্রিক শকটা দর্শক খাবেন তা বোধহয় সহজে মন থেকে যাবে না।