ফ্যান দেখার পর ভক্তি শ্রদ্ধাও উঠে যাওয়ার পথে

Updated By: Apr 18, 2016, 03:06 PM IST
ফ্যান দেখার পর ভক্তি শ্রদ্ধাও উঠে যাওয়ার পথে

স্বরূপ দত্ত

 

সেই যে সময়টা আমার বেড়ে ওঠা স্কুলের চৌহদ্দিতে, সেই সময় রুপোলি পর্দায় এন্ট্রি তাঁর। শাহরুখ খান। কিং খান, বাদশা, এসআরকে। এসব বিশেষণ তো এলো অনেক পরে। শুরুর দিকের সেই ফৌজি বা সার্কাসের ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগে বলে, স্কুল পিরিয়ডের মাঝেই বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা একটু আধটু। তারপর চমত্‍কার, রাজু বন গয়া জেন্টলম্যান এবং দিওয়ানার পর তো শাহরুখ খানের ফ্যান বনে যাওয়া। রোজ টিফিনের পয়সা থেকে একটু একটু বাঁচিয়ে ৫০ পয়সা করে দুটো অন্তত শাহরুখের ছবি কেনা। একদিন দুটো-দুটো করতে করতে আমি ১০০০ ছবির মালিক! সব ছবিতে শুধুই শাহরুখ। জবরদস্ত ফ্যান তখন আমি। বন্ধু থেকে দাদা-ভাইদের সঙ্গে তর্কে, আমার সঙ্গে কে আর পেরে ওঠে! তাই ফ্যান রিলিজ মাত্রই চলে গেলাম হলে। পরেরটুকু বলার আগে আর একটু বলে নেওয়া ভালো। মাঝের দুই যুগ সময়ের মধ্যে জীবনের নিয়মেই অনেক মানসিক এবং চারিত্রিক পরিবর্তন এসেছে আমার। সেই হাজার ছবির মালিক আমি এখনও তাঁর আছি। কিন্তু তর্কটা আর করে ওঠা হয় না। কারণ, সময়ের অভাব বা জীবন বদলে গিয়েছে বলে নয়। কারণ, আত্মবিশ্বাসের অভাব। যে মানুষটা হ্যাপি নিউ ইয়ারের হিরো, যে মানুষটা দিলওয়ালের হিরো, তাঁর ফ্যান বলতে গর্ব হয় না। কুণ্ঠাই বোধ করি। তবু, শুরু হল ফ্যান। আর তারপর মনের মধ্যে যেগুলো চলল, বলি একে একে....

১) এটা ফ্যান না হয়ে ডামি হলে ঠিক ছিল - জানি না, কেন ফিল্মের নাম ফ্যান রাখা হল! কেন, অগণিত ফ্যানদের সঙ্গে এই ধোঁকাবাজি! এই দেশ ছাড়ুন, এই রাজ্য ছাড়ুন, শুধু কলকাতা শহরেই লাখো ফ্যান রয়েছে শাহরুখের। এরা সবাই দেখতে কী শাহরুখ খানের মতো নাকি! অবাক হয়ে গেলাম, ব্যাপারটা দেখে। গোঁড়ায় এতবড় ভণ্ডামি হলে, তার উপরের উড়ালপুল ভেঙে পড়বে এতে আর আশ্চর্য কী! হাজার হাজার মানুষ, তাদের পছন্দের মানুষ দ্বারা প্রভাবিত হন। খুব সত্যি কথা। কিন্তু সবাই তো দূর, এক শতাংশও তাঁদের মতো দেখতে হয়ে যায় নাকি! যদি শাহরুখের ফ্যানকে শাহরুখের মতো দেখতে না হতো, তাহলে এ ছবির কী এমন ক্ষতি হতো! বরং, সেটাই আম দর্শক বা সত্যিকারের শাহরুখ ফ্যানদের আকৃষ্ট করত হয়তো।

২) শাহরুখ কী ফ্যানের পর রিও অলিম্পিকে যাবেন ! - গোটা ছবিটা দু ঘণ্টা ১৮ মিনিটের। এর মধ্যে ১ ঘণ্টা ১৮ মিনিট তো শাহরুখ খান শুধু দৌড়লেন! আগে গৌরব। পিছনে আরিয়ান খান্না। দুই শাহরুখ মিলে এই ছবিতে যত কিলোমিটার দৌড়েছেন, জানা নেই, উসেইন বোল্টরাও অলিম্পিকের আগে এত প্র্যাকটিস করছেন কী না! শাহরুখকে দিয়ে মণীশ শর্মার স্বপ্ন কী তাহলে রিও অলিম্পিকের পটভূমিতে ফের একটা কিছু বানানো! না হলে এটা নিশ্চয়ই ভাগ, মিলখা ভাগের দ্বিতীয় পার্ট বানিয়েছেন তিনি। ভাগ ফ্যান ভাগ অথবা ভাগ শাহরুখ ভাগ।

৩) এত দূর্বল চিত্রনাট্য যে ফ্যানের লিকলিকে শরীরের থেকেও দূর্বল - জীবনে প্রথম এতবড় ফ্যানকে দেখলাম! সে আরিয়ান খান্না ছাড়া কিছু বোঝে না। কিন্তু দু ঘণ্টা ১৮ মিনিটে তাঁকে একবারও দেখিনি আরিয়ান খান্নার একটা সিনেমা অন্তত দেখছেন! এখানে যাকে ফ্যান বলে চালানো হল, সে তো ফ্যান নয় আসলে। হিরো। হ্যাঁ, পাক্কা হিরো। কারণ, সে নিজেই এখানে পারফর্ম করে। আমাদের বাস্তব জীবনের অনেক ফ্যানদের দেখেছি। তাঁরা যাঁর ফ্যান তাঁকে গুরুত্ব বেশি দেন। এই ছবিতে ফ্যানও যে শাহরুখ। ওটাই হয়েছে মণীশ শর্মার কাল। অত সহজ দাদা? পরিচালক মানুষ। অভিনেতাদের নিয়ে নাড়েন-টাড়েন। মনস্ত্বত্ব বোঝেন। কিন্তু ফ্যানদের মনোস্ত্বত্ব বুঝতে আপনাকে আরও ক'বছর অপেক্ষা করতে হবে।

৪) লন্ডন পুলিশ মানহানির মামলা করতে পারে ! - তিনি এত বড় স্টার আরিয়ান খান্না। যাঁকে দেখতে জন্মদিনে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেই মানুষটার এক ডামি গোটা মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটাল। বন্দুক ঠেকাল। তার পরিবর্তে লন্ডন পুলিশ কিনা ধরল, আরিয়ান খান্নাকেই! মাইরি, এদের অবস্থা দেখে কলকাতা পুলিশের রাহুল সিনহাকে ঘুষ দিতে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সে নামডাক আর নেই। তা বলে, তাঁদের অবস্থা এখন এমন! এটাও হলে বসে দেখতে দেখতে আমি আর যার বড় ফ্যান, সেই শার্লক হোমসের কথা মনে পড়ল! কোনান ডয়েল ফের লিখলে, ফ্যানের লন্ডন পুলিশকে দেখে কী লিখতেন জানার একটা আগ্রহ এলো মনে।

৫) শাহরুখ আপনি পিছনের দিকে এগোচ্ছেন - আমির খান নিজেকে যেখানে নিয়ে গিয়েছেন, সেখান থেকে বোল্টের মতোই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিতে পারেন যে, শাহরুখরা তাঁর থেকে ঠিক কতটা পিছনে। সলমন খান এত বড় অভিনেতা-টেতা নন। তিনি, আড়াইশো কোটি, তিনশো কোটি। তাই নিয়েই আছেন। কিন্তু তিনি শাহরুখ খান। তিনি তাহলে আছেনটা কী নিয়ে? শুরুর দিকের দিনগুলোয় খুব তর্ক করতাম, কত বড় অভিনেতা শাহরুখ খান, এসব বলে-টলে। কিন্তু এখন আর শাহরুখ অভিনয়টা করেন কোথায়! কখনও ছটা, কখনও আটটা প্যাক দেখান আদুল গায়ে। কখনও শুধু দৌড়ন। কখনও গ্যারেজ মেকানিক হয়ে নিজেকে বডি বিল্ডারের মতো করে হাঁটেন চলেন। শরীরটা গড়েছেন এটা বোঝানোর জন্য হিমেশ রেশমিয়াও ক্যামেরার সামনে যে অভিব্যাক্তি দেন, শাহরুখ খানও তাই।

সবশেষে - না, আমার সঙ্গে শাহরুখ ওই গৌরবের মতো ব্যবহার করেননি যে, আমার খুব রাগ হয়েছে তাই এমন লিখলাম। আসলে, সত্যিই ফ্যান ছিলাম শাহরুখের শুরুর দিনগুলোয়। মাঝের দিনগুলোয়। কিন্তু এখন তিনি যাতে পরিণত হয়েছেন, এটা আর মন কিংবা মাথা কোনওটাই টানে না। ফ্যান এখন আমার কাছে অতীত। আসলে শাহরুখ আর তাঁর ফ্যানদের ধরে রাখতে পারছেন না। এটা পর্দার ফ্যান এবং বাস্তবের ফ্যানের মধ্যে একটাই মিল। তবু তাঁকে ফ্যানরা আজও ভালোটালো বাসছে, এটাও সেই পুরোনো সেই দিনের অভ্যেস আর স্মৃতির দৌলতে। শাহরুখ এখন কিং হয়েছেন। ফ্যান এখন হয়তো তাঁর কাছে প্রজাসম। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত মতামত। এটা পড়ে ফিল্ম দেখতে যাবেন কী যাবেন না, এটা অনুগ্রহ করে ঠিক করবেন না।

.