মোবাইলেই মগজধোলাই? কৃত্রিম-মগজের খপ্পড়ে সভ্যতার সঙ্কট! তথ্যচিত্রে তোলপাড়
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি এই মারাত্মক আকর্ষণ কিংবা আসক্তিই এখন বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের কারণ।
ঊষসী মুখোপাধ্যায়
নিজস্ব প্রতিবেদন: মোবাইলে কী এমন আছে, যে সর্বক্ষণ ডুবে থাকতে হয়? প্রশ্নটা আগে বাবা-মায়েরা করতেন। কিন্তু এখন বাবা-মায়েদের মোবাইল আসক্তি দেখে সেই প্রশ্নই তুলতে শুরু করেছে ছেলেমেয়েরা! নিজেই ভেবে দেখুন, মোবাইলে সারাদিন কী করেন আপনি? ভিডিও দেখেন? হোয়াটসঅ্যাপ করেন? নখদর্পণে ফেসবুক তো আছেই! তাই নিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে কী করে? কেন? এই উদ্ভট আসক্তির শিকড়-সন্ধান করেছেন কখনও?
না, আমরা কেউই বোধহয় করিনি। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি এই মারাত্মক আকর্ষণ কিংবা আসক্তিই এখন বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের কারণ।
২০১৭ সালে ফেসবুকের অফিসে আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটেছিল। ঠিক যেমন সিনেমায় হয়! ফেসবুকের বিশেষ একটা প্রজেক্টে তখন আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে চুটিয়ে কাজ চলছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাঠ পড়ানো হচ্ছে সুপারকম্পিউটারকে। হঠাত্ দেখা যায়, মানুষের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বললেও সেই বুদ্ধিধারী কম্পিউটাররা নিজেদের মধ্যে কোড-ল্যাংগোয়েজে কথা বলছে! এমন কোড, যা তাদের শেখানো হয়নি। যে ভাষা মানুষের সম্পূর্ণ অজানা! কৃত্রিম মস্তিষ্কের এই 'উন্নয়ন' দেখে আঁতকে ওঠেন ইঞ্জিনিয়াররা! তড়িঘড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয় গোটা প্রকল্প। তড়িঘড়ি সব চ্যাটবটের প্লাগ খুলে নেওয়া হয়! জুকেরবার্গের এই আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত,সেই সময়েই খোঁচা দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন টেসলা-র সিইও ইলন মাস্ক।
কৃত্রিম মগজ একবার তৈরি করে ফেললে তারা একদিন মানুষকে চেকমেট দেবে। সেদিন বেশি দূরে নয়, ২০২৫ এর মধ্যেই মানুষকে ঠুঁটো করে দিয়ে গিলে খাবে যান্ত্রিক মগজ। ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন খোদ স্টিফেন হকিং!
তবে সেসব সতর্কবার্তায় বিশেষ পাত্তা না দিয়েই প্রযুক্তির বিজয়পথ তরতরিয়ে এগিয়েছে! মাস্ক-হকিংরা যা বলছেন, তা সত্যি হলে কী হবে, সেসব না ভেবেই এগিয়ে গিয়েছি আমরা! ভুলটা বোধহয় সেখানেই। এটা যে ঠিক কত বড় ভুল, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নেটফ্লিক্সের তথ্যচিত্র দ্য সোশ্যাল ডিলেমা। আপনার মোবাইল স্ক্রিনের ওপারে ঠিক কী কলকাঠি নাড়া হচ্ছে,যাতে আপনার হাত থেকে ফোনখানা সরানোই যাচ্ছে না? কে করছে? কী করছে? আড্ডাচ্ছলে সেই ওপার-দর্শন করিয়েছে 'দ্য সোশ্যাল ডিলেমা'!
যাঁরা এই তথ্যচিত্রে দেখা দিয়েছেন, কথা বলেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা টেক-সংস্থার প্রাক্তন কর্ণধার। মোটা মাইনের সে-সব চাকরি কার্যত বাধ্য হয়ে ছেড়েছেন তাঁরা। কারণ, এথিক্যাল ডিলেমা। অর্থাত্ নৈতিকতার সঙ্কট! নিজেমুখে বলছেন, একসময় ফেসবুকে লাইক অপশন তৈরি করা হয়েছিল পজেটিভিটি ছড়ানোর জন্য। খুশি জাহিরের জন্য। কিন্তু কালক্রমে সেই ফেসবুকের অন্ধকার দিকটা একটাই প্রকাণ্ড চেহারা নিয়েছে, যে সেই লাইক অপশনের কথা মনে পড়লে নিজের বুড়ো আঙুলটা কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে!
আপনার মোবাইলের প্রতি এই গভীর আকর্ষণের কারণ খোলসা করে বলছেন তাঁরা। বলছেন, মানুষের হাতে নয়, আপনার মগজ-ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করছে আর্টিফিশিয়াল ইনটালিজেন্স!
আপনার অজান্তেই আপনার আচরণের 'প্যাটার্ন' তৈরি করে নিচ্ছে সেই সব অশরীরী সুপার-মগজ। সেই প্যাটার্নকে ব্যবহার করে আপনাকে মোবাইলে আসক্ত করে তুলছে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কী দেখছেন, কতক্ষণ দেখছেন, কোন পোস্টে লাইক করছেন, কোনটায় আপনার প্রবল আপত্তি, সব নজরে রাখছে এই কৃত্রিম মহামগজ! তারপর? মোটা টাকায় আপনার সেই আসক্তিকে বিক্রি করছে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে! সহজ করে বললে, আপনার মোবাইলের গতিবিধি ট্র্যাক করে রিয়েল লাইফ আচরণ কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, মতামতে কীভাবে ভাগ বসানো যায়, সেই মন্ত্রই আবিষ্কার করে ফেলেছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমানরা! ফলে, ভোটের জনমত গঠনই হোক, কিংবা সাবান-শ্যাম্পুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ হোক, আপনার আগে আপনার 'পালস' ধরে ফেলছে তারা! যে 'পালসে'র জোরে ফেক নিউজ, হিংসা, বিদ্বেষ, সাইবার বুলিইং... এমনকী রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতেও ওস্তাদ সেই মগজাস্ত্র! গতবছরই বাংলায় সাড়া ফেলেছিল হোয়াটসঅ্যাপে ছেলেধরার ভুয়ো খবরের হিড়িক! ফেসবুকের পোস্টে 'হেটস্পিচ', কেমব্রিজ অ্যানালেটিকা, বয়েজ লকার রুম, বিদ্বেষ ছড়ানোর বীজ,ঝুটো খবরের কোটি কোটি শেয়ার, দিল্লি থেকে বেঙ্গালুরুর ঘটনায় আশঙ্কার পারদ চড়েছে আমাদের দেশেও। এই করোনা-আবহে রাষ্ট্রসঙ্ঘকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছে, করোনা-আবহে একটা নয়, দুটো মহামারীর সঙ্গে লড়ছে মানুষ। একটা প্যানডেমিক। আর দ্বিতীয়টা ইনফোডেমিক, অর্থাত্ ভুল খবরের মহামারী!
মগজধোলাই ছাড়া একে আর কীই বা বলা যায়?
ফেসবুক অবশ্য পত্রপাঠ সেই তথ্যচিত্রের সব দাবি খারিজ করেছে। মোদ্দা কথায়, ছবির পয়েন্ট ধরে ধরে কৈফিয়ত দিয়েছে জুকেরবার্গের সংস্থা। বলেছে, আসক্তি নয়, মানুষে-মানুষে মেলবন্ধনই তাদের লক্ষ্য। ফলে, তাদের মতে আপনার আসক্তিকে বিক্রি করেই ফেসবুক টাকা কামাচ্ছে সেই তত্ত্বও দাঁড়াচ্ছে না! সংস্থা যাই বলুক, আমি-আপনি ভেতর ভেতর বিলক্ষণ এই আসক্তি টের পাচ্ছি। মানুষের হাতে গড়া আর্টিফিশিয়াল ইনটালিজেন্স কি সত্য়িই মানুষকে চেকমেটের সামনে বসিয়ে দিচ্ছে? এই মারণ-নেশা থেকে মুক্তি কীভাবে সম্ভব? আদৌ সম্ভব কি?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নেশা একটা চক্রব্যুহের মতো। ঢুকে পড়লে বেরোনোর রাস্তা প্রায় নেই। হকিং এই সঙ্কটের আঁচ পেয়েছিলেন। সেই ২০১৪ বলেছিলেন, 'আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স মানুষজাতিকে ধুয়েমুছে সাফ করে দেবে। তারা নিজেরাই নিজেদের মগজে ধার দিতে শিখে ফেলবে! মানুষের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজকে এই পর্যায়ে পৌছেছে। যন্ত্র-মগজ কিন্তু এক মুহূর্তে সেই মগজকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে!'
কৃত্রিম-মগজের হাত থেকে নিস্তার পেতে হলে মোবাইল থেকে নিজেকে আনপ্লাগ করতে হবে! সেটা কি এই মুহূর্তে সত্যিই করা সম্ভব? শুধু অ-কাজ তো নয়, কাজের জন্যও তো মোবাইল-নির্ভর আমরা!
প্রহসন বোধহয় একেই বলে! দেখুন, এই লেখাটাও আপনি অনলাইনেই পড়ছেন!
হয়তো ফেসবুকেই!