ঋতুপর্ণ ও তাঁর নারীরা

চলে গেলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। বড় অকালে। দিয়ে গেলেন একরাশ শূন্যতা। বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র হারাল তার দোসর।

Updated By: May 30, 2013, 03:08 PM IST

চলে গেলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। বড় অকালে। দিয়ে গেলেন একরাশ শূন্যতা। বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র হারাল তার দোসর।
সর্বকালীন ও সমকালীন ভারতীয় চলচ্চিত্র ঋতুপর্ণ ঘোষকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তিনি নিজের একেবারে স্বতন্ত্র একটি ধারা তৈরি করেছিলেন। সেই ধারায় বার বার উঠে এসেছে বিভিন্ন নারী চরিত্র। ঋতুপর্ণের একের পর এক সিনেমায় যে ভাবে বিবিধ নারী চরিত্রের উপস্থিতি এবং উত্তরণ ঘটেছে তা একথায় অনন্য, অনবদ্য। ঋতুপর্ণ ব্যাতীত অন্য কোনও ভারতীয় চিত্র পরিচালক এই ভাবে তাঁদের সিনেমায় মেয়েদের জীবনের বিবিধ দিক নিয়ে এত বেশি গবেষণা করেছেন কী না তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাবে। তাঁর নায়িকারা সাহসী, ব্যতিক্রমী, নিয়ম ভাঙার নেশায় মত্ত। অন্যদিকে তারাই আবার ভীষণ চেনা, ভীষণ কাছের।
ঋতুপর্ণের সিনেমার কিছু নারী চরিত্ররা ফিরে এলেন আমাদের পাতায়
উনিশে এপ্রিল: সরোজিনী ও অদিতি
উনিশ এপ্রিল এক মা আর তাঁর মেয়ের গল্প। প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী সরোজিনী তাঁর সংসার জীবনে সাফল্য থেকে কিছুটা সরে এসেছিলেন। সবার অলক্ষে ডাক্তার স্বামীর মনের মধ্যে জমা হয়েছিল কিছু ভাষাহীন হিংসা। বাবার ছত্রছায়ায় মানুষ হওয়া অদিতি ছোট থেকেই মা এবং তাঁর সাফল্যকে ঘৃণা করতেই শিখেছিল। বড় হয়েও অদিতির প্রেমিক ডাক্তার সহপাঠী তাকে তার মায়ের পেশার দোহাই দিয়ে ছেড়ে চলে যায়। এক ঝড়ের রাতে হতাশাগ্রস্থ আত্মহত্যারত অদিতি হঠাৎ করেই বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীর আড়ালে আবিষ্কার করে তার মাকে। মাও খুঁজে পান তাঁর একমাত্র মেয়েকে। মা আর মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়ন মধ্যেই কোথায় যেন ফুটে ওঠে সমকালীন সমাজের প্রতিচ্ছবি।
দহন: রমিতা ও ঝিনুক
সদ্যবিবাহিত রোমিতা ও তাঁর স্বামী পলাশকে প্রকাশ্য রাস্তায় হেনস্থা করে কিছু দুষ্কৃতী। শ্লীলতাহানির শিকার হয় রোমিতা। কেউই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না তাঁদের দিকে। এগিয়ে আসে স্কুলশিক্ষিকা ঝিনুক। এই একটি ঘটনায় সংবাদমাধ্যম নায়িকা বানিয়ে দেয় ঝিনুককে। কিন্তু ঝিনুক চায় দুষ্কৃতীদের শাস্তি। রোমিতা ঝিনুকের পাশে দাঁড়াতে চাইলেও লোকলজ্জার দোহাই দিয়ে তাঁকে প্রতিহত করতে চায় তার স্বামী। বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকার হয় রোমিতা। শেষ পর্যন্ত বাড়ির চাপের কাছে মাথা নত করে সে। তারই জন্য ঝিনুক যে যুদ্ধটা শুরু করেছিল সেই যুদ্ধেই ঝিনুকের পাশে দাঁড়াতে পারে না রোমিতা। তথাকথিত উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত গৃহবধূ রোমিতা হেরে যায় সমাজের কাছে। পরিস্থিতির কাছে হার মানে ঝিনুক, হতাশা গ্রাস করে তাকে। কিন্তু কোথায় যেন বেঁচে থাকে ঝিনুকের প্রতিবাদ।
বাড়িওয়ালি: বনলতা
লোকে বলতো বিয়ের রাতে নআকি বনলতার হবু স্বামীকে সাপে কেটেছিল। সেই থেকেই বনলতা একা। নিঃসঙ্গ। বনলতার বিশাল বাড়ি ভাড়া নিয়ে শুটিং করতে আসে একটি ফিল্ম প্রডাকশন হাউস। নিজের অজান্তেই বনলতা জড়িয়ে পড়ে সিনেমা পরিচালক দীপঙ্করের সঙ্গে। দীপাঙ্কর বিবাহিত, নিজের সিনেমার নায়িকার প্রতি অনুরক্ত জেনেও বনলতার নিঃসঙ্গ জীবন হঠাৎ যেন বাঁধন ছিঁড়ে মুক্তি খোঁজে। দীপঙ্করও ইঙ্গিতপূর্ণ সম্পর্কের হাত বাড়িয়ে দেয় বনলতার দিকে। তার ছবিতে ছোট একটা ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য রাজি করেই ফেলে বনলতাকী। শুটিং শেষে দীপঙ্কর তাঁর দলবল নিয়ে ফিরে যায়। দীপঙ্করকে লেখা বনলতার একটার পর একটা চিঠি তার সঙ্গেই যেন দীপঙ্করের উত্তর খুঁজে ব্যর্থ হয়। রিলিজ হওয়ার পরে দেখা যায় দীপঙ্করের সিনেমা থেকে বাদ পড়েছেন বনলতা। আরও একবার তীব্র নিঃসঙ্গতাই সঙ্গী হয় বনলতার। 

শুভ মহরত: রাঙা পিসি ও পদ্মিনী চৌধুরী
পদ্মিনী চৌধুরী, বিগত দিনের খ্যাতনামা অভিনেত্রীর প্রযোজনায় তাঁর স্বামীর সিনেমার সেটে ঘটে যায় একটি হত্যা। সেই হত্যা রহস্যে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে যান সাংবাদিক মল্লিকার ঘরোয়া বিধবা রাঙা পিসি। রহস্য গল্পের মোড়কে একদিকে সন্তানহারা পদ্মিনীর প্রতিশোধ স্পৃহা অন্যদিকে আপাতত দৃষ্টিতে সাধারণ কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধির রাঙা পিসিমার কথোপকথনের পরতে পরতে বিবিধ সম্পর্কের উত্তরণ ঘটেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিপরীতধর্মী কিন্তু বাংলাসিনেমার সর্বকালের অন্যতম সেরা দুই নারী চরিত্রের।
চোখের বালি: বিনোদিনী ও আশালতা
এই বিনোদিনী রবীন্দ্রনাথের বিনোদনী ছায়ানুসারি হয়েও স্বতন্ত্র। বাল্য বিধবা এই নারী সমাজকে অগ্রাহ্য করে নিজের শারীরিক চাহিদা, ভালবাসা প্রকাশে অকপট। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আত্মমর্যাদা রক্ষায় একদা কাম্য ভালবাসাকেও অবলীলায় ফিরিয়ে দেয় সে। অন্যদিকে, কিশোরী, স্বামীর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, অশিক্ষিত আশালতাও দ্বিচারী স্বামীর বিরুদ্ধে নিঃশব্দ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
অন্তরমহল: মহামায়া
নপুংশক জমিদার স্বামীর অক্ষমতাকে সতীনের সামনে জোর গলায় তুলে ধরে মহামায়া। তাকে বন্ধন মুক্তির জন্য উৎসাহিত করে। ঘৃণার সঙ্গে সামনে আনে ধর্মের নামে পুরোহিতদের যৌন লালসার রূপ। মেয়েদের দৈহিক চাহিদাকে অন্য মাত্রা দেয় মহামায়া। যদিও সেই পুরোহিতদের ঘৃণ্য চক্রান্তের স্বীকার হতে হয় তাঁকে। আপাতদৃষ্টিতে পরাজিত হয় তাঁর বিদ্রোহ।  মহামায়ার বিদ্রোহ অন্তরমহলের মধ্যে আবদ্ধ থেকেও তবুও কোথায় যেন তৎকালীন সমাজের ঘৃণ্য, বিকৃত রূপ সামনে নিয়ে আসে।

.