'চৌকিদার' এই বলে খ্যাত হোক, মোদী তোমাদেরই লোক! শ্রমের নামে শো-ম্যানশিপ?
সার্জিক্যাল প্রাইম মিনিস্টার দাপিয়ে মঞ্চ মাতাচ্ছেন। কিন্তু বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন, চৌকিদার সাজা আর চৌকিদার হওয়া আদতে মোটেও এক নয়।
ঊষসী মুখোপাধ্যায়
দ্য শো মাস্ট গো অন।
উনিশ শতকের সার্কাসের মঞ্চে তৈরি হওয়া লাইনটা আজও কী ভয়ঙ্কর সত্যি! বিশেষত, ভারতীয় রাজনীতির ময়দানে। মঞ্চের দিকে একঝলক তাকালেই বুঝবেন, হেলমেটে বাউন্সার খেয়েও ক্রিজ ছেড়ে একচুল না নড়া কাকে বলে। অন্তঃসারশূন্য হয়েও কীভাবে দাপুটে কথায় 'শো' চালিয়ে যাওয়া যায়! সময়ের সঙ্গে এই আপ্তবাক্যের অর্থের বিবর্তনও হয়েছে। প্রথমে কথাটার মানে ছিল, সার্কাসে কোনও অঘটন ঘটলেও এমনভাবে ড্যামেজ কন্ট্রোল চালিয়ে যাওয়া, যাতে দর্শক টেরই না পায়।
এখন 'শো' মানে বৃহত্তর অর্থে রুপোলি পর্দা ধরতে পারেন। আবার অন্তঃসারহীন, দেখনদারির ফাঁপা রাজনীতির কথা বলতে গেলেও এই লাইনটার জুড়ি মেলা ভার!
নরেন্দ্র মোদীকে টিভি স্ক্রিনে দেখলেই আজকাল এই লাইনটার কথা মনে পড়ে যায়। দেখনদারির রাজনীতি যে কী ভয়ডরহীন ভাবে জাহির করা যায়, ওঁর চেয়ে ভালো আর কেউ বোধহয় জানেনই না। রাজনীতিক বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেমনই হোন, শো-ম্যান মোদী কিন্তু একশোয় একশো!
২০১৪-র সেই ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি, হালে চৌকিদার নামেই বাজার গরম করছেন। পাঁচ বছর আগে এক্কেবারে বাঁটুলের আদলে যিনি বুক চিতিয়ে দেশকে রক্ষা করার বার্তা দিচ্ছিলেন, এখন তিনি পাহারাদার। শো-ম্যান নয়, বলুন তো? এ যেন একই অভিনেতার বিভিন্ন চরিত্রাভিনয়!
চৌকিদার। শব্দটায় আগাগোড়া একটা ভারতীয় গন্ধ আছে। উর্দু থেকে জন্ম। গত কদিনে পাহারাদারের এই চলতি প্রতিশব্দটার মানেই পাল্টে দিয়েছেন মোদী। চৌকিদার বললে আপনার কী আর ৭৪ সালের সেই হিন্দি সিনেমাটার কথা মনে পড়ে? না ছদ্মবেশীর হিন্দি চুপকে চুপকের মাঙ্কিক্যাপ পরা চৌকিদার-রূপী ধর্মেন্দ্রকে? বা ধরুন বুদ্ধদেব গুহর কলমের কোনও এক ডাকবাংলোর চৌকিদারের হাতের মুরগির ঝোল... কোনওটা মনে পড়ে কি?
না। শব্দটির সর্বৈব রাজনীতিকরণ হয়েছে। এই না হলে দক্ষ শো-ম্যান?
নামটুকু নিয়ে অবশ্য তিনি ক্ষান্ত হননি! চৌকিদারের কপিরাইট কব্জা করতে তিনি দেশের ২৫ লক্ষ চৌকিদারদের সঙ্গে অডিও-চ্যাটও করেছেন।
সার্জিক্যাল প্রাইম মিনিস্টার দাপিয়ে মঞ্চ মাতাচ্ছেন। কিন্তু বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন, চৌকিদার সাজা আর চৌকিদার হওয়া আদতে মোটেও এক নয়।
সেকালের চৌকিদার এখন কোথায়? শহুরে বহুতলে তাঁরা এখন 'সিকিওরিটি গার্ড' নামেই পরিচিত। শ্রমজীবী মানুষের জীবনে বাঁচা আর চড়া মেকআপে শ্রমজীবীর নাম ধার করা, এক নয়। এক হতে পারে না!
এ দেশের আসল চৌকিদারদের কী অবস্থা, দিনরাত এক করে তাঁদের কী নিরন্তর ঘাম ঝরাতে হয়, তাঁদের সংসারের দৈন্যদশার কথা, 'চৌকিদার' জানেন? রোজগার বলতে সামান্য কটা টাকা। দুই থেকে আড়াই হাজার। নাইট ডিউটিতে চোখ বুজে আসা নিষেধ। সপ্তাহে সাত দিন ডিউটি। আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটের ম্যাডামকে দেখে উঠে না দাঁড়ালে পত্রপাঠ চাকরি খাওয়ার হুঁশিয়ারিও আসে বৈকি।
আসল চৌকিদাররা এভাবেই বাঁচেন। বাড়িতে বাড়িতে যারা 'সিকিওরিটি গার্ডের' কাজ করেন, তাঁদের অনেকেরই বয়স হয়েছে। কেউ হয়তো কোনও চটকলে কাজ করতেন, কারও আজীবনের জমানো টাকা চিটফান্ডের দয়ায় ভ্যানিশ! কারও বেকার ছেলে আজও জুতোর শুকতলা খুইয়ে চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে। আর তাঁর বৃদ্ধ বাবা? অশক্ত শরীরেও ঘানি টানছেন।
উপায় যে নেই। দুবেলা খেতে হবে তো!
ওঁরা বোধহয় জানেনই না। ওঁরাই এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে চর্চিত বিষয়! দেশের প্রধানমন্ত্রীর মিডলনেম!
চৌকিদারের পোশাকে তিনি ভোট কুড়োবেন। আর ঘাম-রক্ত এক করে, অসুস্থতা চেপে রেখে অসহায় জীবন যাপন করে যাবেন চৌকিদাররা। এটা কি শ্রমজীবী মানুষের নামে ফাঁপা দেখনদারি নয়?
মোদী অবশ্য একাজে বেশ পোক্ত। কুম্ভমেলায় ডুব দিয়েই ক্যামেরার সামনে সাফাইকর্মীর পা ধোয়াতে বসেন।
কিন্তু দেশের সাফাইকর্মীদের জীবনযাত্রা একটুখানি সহজ করতে তিনি একটা কাজও করেননি। সাফাইকর্মীর পা ধুয়ে দিলেই কী তাঁদের প্রতি মানুষের সম্মান বেড়ে যায়? নাকি সরকারি মসনদে বসে তাঁদের জন্য কিছু কাজের কাজও করতে হয়?
যিনি নিজেকে চা-বিক্রেতা পরিবারের ছেলে বলে দাবি করেন, মায়ের কঠিন জীবনের কথা বলতে বলতে যিনি ফেসবুকের অফিসে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, তিনি সত্যিই জানেন শ্রমজীবীদের কথা? হাড়ভাঙা পরিশ্রম, লোকের বাড়ির টয়লেট সাফ করা 'নিচু জাতের' যন্ত্রনার কথা? ন্যূনতম মজুরির দাবিতে রাস্তায় নামা শুকনো, ফ্যাকাশে মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন 'চৌকিদার প্রধানমন্ত্রী'?
ফেসবুকে-টুইটারে, ভোটের প্রচারে ক্রমাগত শ্রমের সঙ্গে শো-ম্যানশিপ অনবরত গুলিয়ে যাচ্ছে। গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটাই কৌশল। অবচেতনে সিঁধিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে সোজা উপায়। একটাই শব্দ এতবার বলা, যাতে গণঅবচেতনে তার পুরোনো সব মানে ধুয়ে সাফ হয়ে যায়। যাতে মিত্রোঁ বললে মোদীর কথাই মনে পড়ে। যাতে চৌকিদার মানে একমেবদ্বিতীয়ম হয়ে ওঠেন তিনিই!
দেশজুড়ে প্রার্থী দিতে হিমসিম। কিন্তু চওড়া ছাতির চৌকিদার রক্ষাকর্তা চরিত্রে অটল।
চৌকিদার সাজলেই চৌকিদার হওয়া যায় না। সাফাইকর্মীর পা ধোয়ালেই তার সম্মান বাড়ে না। ভাষাতত্ত্বের কঠিন তত্ত্বের হিসেবে, সিগনিফায়ার-সিগনিফায়েড পাল্টে যায়। মানেটা একই থাকে।
রাজা তার কুর্সি ছেড়ে গরিবের পা ধোয়। নামের সঙ্গে রক্ষাকর্তার তকমা সাঁটে। তারপর উত্সব শেষে ফিরে যায় রাজমহলে।
সাফাইকর্মী নোংরা ঘেঁটে ঘরে ফেরার পথে, 'সামান্য ভুলচুকের' জন্য ভরা বাজারে উঁচুজাতের চাবুক সহ্য করে, আমার-আপনার ফ্ল্যাটের নীচের ঘুপচি ঘরটায় শুধু একাই রাত জাগেন আসল চৌকিদার।