পায়ে ব্যথা, একা হাতে ৬ হাজার চিঠি না পৌঁছে সাসপেন্ড পোস্টম্যান!

সম্প্রতি ওধাঙ্গার একটি স্কুলের ঘরে হঠাত্ কিছু চিঠিপত্র পড়ে থাকতে দেখে কয়েকজন ছাত্র। সেইসব কাগজ একটু ঘাঁটতেই বোঝা যায়, এগুলি সবই ঠিকানায় না পৌঁছানো চিঠি। বিভিন্ন গন্তব্যের নাম লেখা চিঠিগুলি এসেছিল স্থানীয় ওধাঙ্গা পোস্টঅফিসে। এরপরই পোস্টঅফিসে চড়াও হন স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা।

Updated By: Aug 15, 2018, 05:16 PM IST
পায়ে ব্যথা, একা হাতে ৬ হাজার চিঠি না পৌঁছে সাসপেন্ড পোস্টম্যান!

নিজস্ব প্রতিবেদন: নতুন খবর আনার কাজ নিয়ে ছুটে চলা রানার কীভাবে রাত দিন এক করে দিগন্ত থেকে দিগন্তে চষে ফেলেন, সে কথা লিখে গিয়েছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। কিন্তু, রানার যদি না ছোটেন, তাহলে কী হয়? উত্তর- জগন্নাথ পুহান হয়। কি, বুঝলেন না তো?

ওড়িশার ভদ্রক জেলার ওধাঙ্গা পোস্ট অফিসের পোস্টম্যান জগন্নাথ পুহানের বিরুদ্ধে চিঠি না পৌঁছানোর অভিযোগ উঠেছে। একদিন-দু'দিন নয়, এক দশক ধরে চিঠি নিজের কাছে জমিয়ে রেখেছেন। জগন্নাথের এই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। জগন্নাথের এমন 'ঠুঁটো অবস্থান' চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দেশের ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থার করুণ পরিস্থিতি। কিন্তু, তার চেয়েও প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে যে প্রশ্নটা তা হল, কাগজে লেখা বা ছাপা চিঠিপত্র আদানপ্রদানের দিন কি সত্যিই গিয়েছে এ দেশ থেকে?

সম্প্রতি ওধাঙ্গার একটি স্কুলের ঘরে হঠাত্ কিছু চিঠিপত্র পড়ে থাকতে দেখে কয়েকজন ছাত্র। সেইসব কাগজ একটু ঘাঁটতেই বোঝা যায়, এগুলি সবই ঠিকানায় না পৌঁছানো চিঠি। বিভিন্ন গন্তব্যের নাম লেখা চিঠিগুলি এসেছিল স্থানীয় ওধাঙ্গা পোস্টঅফিসে। এরপরই পোস্টঅফিসে চড়াও হন স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা।

জানা যায়, ২০০৪ সাল থেকে সংশ্লিষ্ট পোস্টঅফিসটির পোস্টমাস্টার না থাকায় একমাত্র পোস্টম্যান জগন্নাথ পুহানের উপরই বর্তায় অতিরিক্ত দায়িত্ব। কিন্তু, দীর্ঘদিন ধরেই পায়ের ব্যথায় ভুগছেন পুহান। তার স্বীকারোক্তি, যন্ত্রণা এতটাই বেশি ছিল যে তার পক্ষে আর সব চিঠি গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে সে 'বেছে বেছে' নির্দিষ্ট কিছু 'প্রয়োজনীয়' চিঠিই পৌঁছে দিয়েছে প্রাপকদের কাছে। আর বাকি চিঠিগুলি মানে যেগুলি পুহানের মতে 'ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়', সেগুলির ঠাঁই হয়েছিল স্কুল বাড়িটির একটি ঘরে। উল্লেখ্য, ওই স্কুলবাড়িটিই দীর্ঘকাল ওধাঙ্গা পোস্টঅফিসের ঠিকানা ছিল। কিছু দিন হল নতুন বাড়িতে চলে এসেছে পোস্ট অফিস। কিন্তু, ছাত্ররা যেসব চিঠি পড়ে থাকতে দেখেছে, তার মধ্যে তো পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড থেকে চাকরির চিঠি সবই রয়েছে! তাহলে, পুহানের মতে কোন চিঠিগুলি 'গুরুত্বপূর্ণ'?

অভিযোগ পেতেই তদন্ত শুরু করেছেন ভদ্রক পোস্টাল সার্কেল-এর সুপারিনটেনডেন্ট সর্বেশ্বর মিশ্র। তিনি তদন্ত করে জানতে পারেন, এতদিন ধরে কেবল মাত্র রেজিস্ট্রি চিঠি এবং আধার কার্ড, প্যান কার্ডের মতো নথিগুলিই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে জগন্নাথ পুহান। কারণ, এইসব নথিগুলি না পৌঁছলে, সহজেই কর্তব্যে গাফিলতি প্রকাশ পেয়ে যেত। আর সেই বিষয়টা ভালভাবেই জানা ছিল ১৯৭৯ সালে কাজে যোগ দেওয়া জগন্নাথ পুহানের। তাই সে বেশ ভেবেচিন্তেই বেছে নিয়েছে 'দরকারি চিঠিগুলি'।

কর্তব্যে এমন চরম গাফিলতি ধরা পড়ায়, তত্ক্ষণাত্ সাসপেন্ড করা হয়েছে জগন্নাথ পুহানকে। সুপারিনটেনডেন্ট সর্বেশ্বর মিশ্র জানিয়েছেন, কর্মী কম থাকায় এবং নিয়োগ বন্ধ থাকায় ১৯৭৯ সালে পোস্টম্যান পদে যোগ দেওয়া পুহানের উপর ২০০৪ সাল থেকে ওধাঙ্গা পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টারের ভারও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে ১০ বছর যুগ্ম দায়িত্ব সামলানোর পর ওধাঙ্গায় আসেন একজন পোস্টমাস্টার। তিনি ২০১৬ সালে চলে যাওয়ার পর ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত ফের যুগ্ম দায়িত্ব সামলানোর ভার পড়ে পুহানের উপর। ফলে, দীর্ঘকাল জগন্নাথ পুহানই ছিল ওধাঙ্গা পোস্টঅফিসের প্রথম ও শেষ কথা। ফলে, তিনি যতটা পেরেছেন গাফিলতি করে গিয়েছেন।

জগন্নাথ পুহানের এমন কর্তব্যে গাফিলতি এবং তার জন্য সাসপেনশনের খবর ছড়িয়ে পড়েছে জাতীয় স্তরে। বিভিন্ন মহল থেকেই পুহানকে এমন অপরাধের জন্য সমালোচনা করা হচ্ছে এবং সর্বোপরি সে নিজেও সব কথা স্বীকার করে নিয়েছে। তবে, দেশের ডাক ব্যবস্থার একেবারে নীচের স্তরে কাজ করা মানুষদের একাংশ বলছে, পুহান নিশ্চিতভাবে অন্যায় করেছে। কিন্তু, ভারতের প্রত্যন্ত এলাকায় একজন পোস্টম্যানের উপর যে কী অমানুষিক কাজের চাপ থাকে সেটাও দেখিয়ে দেয় এই ঘটনা। পাশাপাশি, পোস্টম্যান পদে যোগ দেওয়া একজন কর্মীর উপর কোন যুক্তিতে কর্তৃপক্ষ এক দশকেরও বেশি সময়ের জন্য পোস্টমাস্টারের মতো গুরু দায়িত্ব ছেড়ে দিল, উঠছে সে প্রশ্নও। আরও পড়ুন- গোয়ার সমুদ্রতটে স্বাধীনতা দিবস থেকে নিষিদ্ধ মদ্যপান

তবে, জগন্নাথ পুহানের এই 'গাফিলতি'র ঘটনা ডাক ব্যবস্থার করুণ ছবি ফের প্রকট করে তোলার পাশাপাশি সামনে এনে দিয়েছে আরও বড় একটি প্রশ্ন। ইনল্যান্ড লেটার, চিঠি লেখা তো কবেই উঠে গিয়েছে, বছর কয়েক আগে দেশ থেকে সরকারিভাবে উঠে গিয়েছে 'টরে টক্কা' টেলিগ্রামও। কান পাতলেই শোনা যায়, ই-মেল ও মেসেজিং অ্যাপের টোন। চোখ মেললেই দেখা যায়, ক্যুরিয়ার সার্ভিসের ঝাঁ চকচকে মস্ত অফিস। কিন্তু, তারপরও স্রেফ কাগজে লেখা চিঠি না পৌঁছনোর অপরাধেও কী করে একজনের চাকরি যায়! না, কোনওভাবেই জগন্নাথ পুহানের কর্তব্যে গাফিলতি ঢাকতে সাফাই দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বেতনভুক কর্মী হিসাবে কর্তব্য পালন না করে নিশ্চিতভাবেই অপরাধ করেছেন। বরং প্রশ্নটা অন্যত্র, তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে গেলে এটাও মেনে নিতে হবে যে এই কর্তব্যটা আসলে কর্তব্যই যা পালন না করা হলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার আড়ালে থাকা প্রকাণ্ড প্রান্তিক ভারতের জন্য আজও জগন্নাথের কর্তব্যটা ভীষণ প্রাসঙ্গিক। আর রবীন্দ্রনাথের অনুপমার মতো জগন্নাথও কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে চাকরি খুইয়ে, তার কর্তব্যটাকেই প্রাসঙ্গিক প্রমাণ করে গেলেন...

.