কলকাতায় ভয় নেই ভাবি!
পুলওয়ামার ঘটনার পর দেশজুড়ে কাশ্মীরিদের উপরে হিংসার অভিযোগ।
কমলাক্ষ ভট্টাচার্য
১৩ বছরে প্রথমবার ভয় পেতে দেখলাম ভাবি তবসসুমকে(নাম পরিবর্তিত)। শাহিন মহম্মদ ভাট এই মরসুমটায় বরাবরই কলকাতায় থাকেন। কলকাতাই ওনাদের অন্ন জোগায়। ২৮ বছর ধরে তিন মেয়েকে নিয়ে কাশ্মীরের পাহাড়িগ্রাম সৌরায় একাকী লড়াই করে আসছেন তবসসুম। পুলওয়ামার পর বনধ, কারফিউ, ছোট মেয়েটার জ্বর-বমিতে চোখ উল্টে যাচ্ছে, ফোন বন্ধ, কর্তা ব্যবসা করছেন কলকাতায়! লড়াই নয়? সেই অসীম সাহসী তবসসুমকে ১৩ বছরে এই প্রথম ভয় পেতে দেখলাম। নিজের জন্য বা মেয়েদের জন্য নয়। এখন কলকাতায় থাকা নিজের স্বামীর জন্য! “আমাদের জন্য চিন্তা করো না, তোমার দাদার জন্য খুব ভয় হচ্ছে! ওকে দেখে রেখো”, ফোনে বললেন ভাবি।
মেয়েদের কাশ্মীরে রাখেন নি শাহিন। তিন মেয়েই এখন বেঙ্গালুরুতে। বড় দুই মেয়ে চাকরিজীবী, ছোট মেয়েটি পড়াশুনো করছেন। এখনও ঘর আগলে রাখেন তবসসুম। আগে থেকে সংগ্রহ করে সবজি বাঁচিয়ে রেখে কোনওক্রমে দুবেলা পেট ভরছে। কাশ্মীরে আতিথেয়তা গ্রহণ করে দেখেছিলাম ঠিক মায়ের মত নিজের পাতের সবজিটুকু কলকাতা থেকে আসা আগন্তুকের পাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন “আমার নুনভাত হলেই হল। কলকাতায় গেলে আমাকে একবার চাংগ্রি মাছ খাওয়াস তো! ” সব সামলে নিতে পারা সেই ভাবির গলা এত কাঁপতে শুনলাম কেন? শাহিন কলকাতায় তো কী হয়েছে? ২৮ বছর ধরে কাশ্মীর-কলকাতা শাহিন ভাইয়ের জলভাত। আমার থেকেও ভাল কলকাতার অলিগলি চেনা, চার লাইন কথার মধ্যে দু একটা আরবি বাদে ঝরঝরে বাংলা বলতে পারেন।
মনে পড়ছে, জন্নত থেকে আমার জন্মভূমিতে নিরাপদে পাঠিয়েছিলেন ভাবি ও শাহিন ভাই। এক বছর পর কলকাতায় ফিরব। জম্মু থেকে হিমগিরি এক্সপ্রেস। বাড়ি ফেরার আনন্দ বদলে গেল অনিশ্চিয়তায়। টানা কারফিউ। বিকেলের পর উপত্যকা যেন শ্মশান। বাড়িতে তিন মেয়েকে রেখে ৮ ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে শ্রীনগর থেকে জম্মু আমাকে পৌছে দেন শাহিন ভাই ও ভাবি। সন্ধে থেকে সারারাত সেই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সিনেমার অনেক মিল পাই। সামনের কাচ নামিয়ে কাশ্মীরি ছেড়ে চোস্ত হিন্দিতে সিআরপিএফের যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ভাবি। ভোটার কার্ড দেখিয়ে বলেছিলেন,“আমার মেহমান, কলকাতার ছেলে। কালকেই ট্রেন। ওকে পৌছে দিতে না পারলে কাশ্মীরের বদনাম হবে”। সেদিন আমাকে সঠিক সময়ে জম্মু পৌছে দেওয়া নিয়ে ভাবির মধ্যে উৎকন্ঠা দেখলেও বিন্দুমাত্র ভয় দেখিনি। সেই ভাবি গলায় এতটা ভয় টের পেলাম কেন?
আরও পড়ুন- কাশ্মীরিদের সঙ্গে নয়, লড়াই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, বার্তা মোদীর
ঝিলাম ও গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে জল। তাও বারবার কাশ্মীর ছুটে গেছে কলকাতার মানুষ। কলকাতাকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে বছরের পর বছর এই শহরেই পড়ে আছে কাশ্মীরিরা। শাহিন ভাইদের ‘বয়কট’ করে দেব?