এক সাংবাদিকের সেনাজীবনের মনে থাকার মত ডায়েরি
পূজা মেহেতা
হ্যাঁ, এখন আমি জানি 'স্বপ্নপূরণ' হলে ঠিক কেমন অনুভূতি হয়। আক্ষরিক অর্থে জীবনের একটা 'স্বপ্নপূরণ' হল আমার।
সিভিলিয়ন হয়েও (যদিও জানি না, সাংবাদিকদের ঠিক সিভিলিয়ন বলা যায় কিনা!) গত তিরিশটা দিন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আমরা ছত্রিশ জন সাংবাদিক ঘর করলাম ভারতের সেনাবাহিনীর সঙ্গে। শুধু ঘরই করলাম না, বলা ভাল ওঁদের মতো করেই ওঁদের সঙ্গে কাটালাম গোটা একটা মাস।
ভাবছেন হয়ত, এটা কী করে সম্ভব? সত্যিই, এটা আসলে অসম্ভব। কিন্তু আমরা যারা 'ডিফেন্স করসপন্ডেন্ট' হওয়ার স্বপ্ন দেখি তাঁদেরকে বাস্তবে যুদ্ধক্ষেত্রে বা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে কীভাবে, নিজেকে বাঁচিয়ে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে হবে সেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যই আয়োজন করা হয়ে থাকে ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে।
এই একটা মাস আমরা মোট ৩৬ জন সাংবাদিক কার্যত একটা স্বপ্নের সরণিতে ছুটলাম। কখনও ভারতীয় নৌসেনার হাত ধরে আইএনএস সুনয়নায় চড়ে তলিয়ে গেলাম আরব সাগরের অতলে, আবার কখনও হিমালয়ের চূড়াতে চড়লাম টগবগিয়ে, আবার এক সময় ভারতীয় বায়ুসেনার সুখোই ৩০ (SU30) যুদ্ধবিমান আমাদের অভিবাদন জানাল মহাশূন্যে। গোটা অভিজ্ঞতাটাই যে চরম রোমাঞ্চকর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
নাথুলা পাসে ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা, প্রতিটা ধাপ বেয়ে বেয়ে মাধ্যকর্ষণের বিরুদ্ধে জান লড়ানো লড়াই করে, বার্মা ব্রিজ টপকে হিমালয়কে পেয়েছি ১৮ হাজার ফুট উচ্চতায় যা সত্যিই বুক ভরিয়ে দেয়। না, বোধহয় একটু ভুল বলা হল, আমাদের গোটা অস্তিত্বটাকে
ই ভাসিয়ে দেয়।
এতটা পড়ে যদি আপনার মনে হয় আমরা শুধু এখানে ওখানে ঘুরেই বেড়িয়েছি, তাহলে আপনি ডাহা ফেল। জেনে রাখুন আমরা কিন্তু রীতিমত ক্লাসে বসে পড়াশোনা করেছি। প্রতিরক্ষা আধিকারিকদের তথ্য সমৃদ্ধ অসাধারণ সব লেকচার শোনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু এই যে এখন বলছি ক্লাসের অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ তা কিন্তু তখন ক্লাসে বসে মনে হয়নি। কারণ সমুদ্র, পাহাড় এক নি:শ্বাসে চষে ফেলার ক্লান্তিতে আমাদের অনেকেরই ক্লাসে বসে চোখ লেগে যেত। আর এখানেই 'মোস্ট প্রফেশনাল' আর্মি অফিসারদের 'বেয়ন্ড দ্য প্রফেশন' চলতে দেখা। কারণ স্যারেরা আমাদের ক্লান্তি ক্ষমা করে দিয়ে একবারের জায়গায় বারবার তাঁদের সেই অসাধারণ লেকচারগুলো শুনিয়েছেন, আমাদের নোট নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।
ফরওয়ার্ড এরিয়ায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা আরও রোমহর্ষক। কারণ ওখানে গিয়েই প্রথম ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রটা কেমন হয় তা মালুম হল। অসম সাহসী যোদ্ধারা যে হাত দিয়ে দেশকে রক্ষা করেন, সেই হাতগুলো ছুঁয়ে আসতে পেরে সত্যি একটা তৃপ্তি অনুভব করেছিলাম। গত এক মাস ধরে আসলে আমরাও অনেকটা মিলিটারি জীবনই কাটিয়েছি-মিলিটারি ভাষায় কথা বলেছি এবং মিলিটারিদের খাবার খেয়েছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮ হাজার ফুট উচ্চতায় সেনার আতিথেয়তায় পকোড়া খেতে খেতে, লুঙ্গি ডান্স গান উপভোগ করার বিরল অভিজ্ঞতাও নিয়ে এসেছি, আসলে একেবারে অন্যরকম কিন্তু দেখতে গোমড়ামুখো মানুষগুলোর কাছ থেকে। আর এসব থেকেই মনে হয়েছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মসংস্কৃতির পীঠস্থান যদি কিছু থেকে থাকে তা হলে সেটাই ছিল আমাদের গত এক মাসের ঠিকানা। এই যে একটু আগেই বললাম, ওরা আসলে অন্যরকম তার একটা ছোট্ট নমুনা দিই-দেখলাম কয়েকজন সেনা খুব সিরিয়াস একটা আলোচনায় ব্যস্ত। মানুষগুলোকে দেখেই ভয় হয়, ভক্তিও হয়। ওমা, দেখি পরক্ষণেই ওরা অন্যরকম। ভাল মনে আছে এত সিরিয়াস মানুষগুলো পরক্ষণেই আমাদের সঙ্গে চিয়ার্সে যোগ দিল। সিগারেটের ধোঁয়ায় মিশে গেল।
যে উচ্চতায় মানুষগুলো অক্লান্ত প্রহরায় অবিচল থাকেন, সেখানে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ৩ শতাংশেরও কম। এই অবস্থায় শ্বাসপ্রশ্বাস জারি রেখে বেঁচে থাকাটাই কার্যত বিলাসিতা। আর ভেবে দেখুন ওই মানুষগুলো ওই পরিবেশে দেশকে রক্ষা করতে, আমাদের গায়ে যাতে একটি আঁচড়ও না লাগে তার জন্য সদা সতর্ক। আসলে ওরা জেগে থাকেন বলেই আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারিই। এই মানুষগুলো দেশের প্রতি ভালবাসা দেখলে সত্যি নিজেকে এঁদের দেশের নাগরিক ভাবতে গর্ববোধ হয়।
যাক, এই গোটা স্বপ্নটা শেষ হয়ে যখন ঘুম ভেঙে গেল তখন চোখ খুলে দেখলাম আমি অফিসের ডেস্কে বসে রয়েছে। মানুষগুলো নেই, রয়ে গিয়েছে ৪০ জিবি ছবি। যা আমি বাকি জীবন গর্বের ছবি হিসেবে আঁকড়ে ধরে রাখব। রোজকার কাজ রোজকার মতই চলছে, চলবে। খবর তো আর থেমে থাকে না, কিন্তু ওঁরা থেমেই রইলেন, ওদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোতে থেমে রইল আমার হৃদয়। আর সেই হৃদয় থেকে একটাই বাক্য বা অনুভূতি বারংবার অনুরণিত হচ্ছে, জয় হিন্দ!