'ক্ষমা করুন আমাকে, যদি সম্ভব হয় ক্ষমা করুন আমাকে'
সৌরভ পাল
রাত তখন ১১ টা বেজে ১৭ মিনিট, বা তারও একটু বেশি। একটু আগেই শেষ হয়েছিল পুরুষদের জিমন্যাস্ট ইভেন্ট। ব্রাজিলের মাটিতে ইংল্যান্ডের পতাকা আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কষ্ট হচ্ছিল। ইংল্যান্ড? সেই পতাকা। চোখ বুজতে ইচ্ছে করছিল, পারছিলাম না। ওই পতাকার বদলে একটা তেরঙ্গা দাও। একটা তেরঙ্গা দাও, এটাই কেমন দ্রিম দ্রিম বাজছিল বুকের বা দিকে। পুরুষ জিমন্যাস্টদের মধ্যে সোনা জিতেছে ইংল্যান্ড। ব্রাজিল পেয়েছিল রুপো আর ব্রোঞ্জ। ভারতকে দেখতে পাবো? আর কয়েকটা মিনিট, তারপরই তো মধ্যরাতের স্বাধীনতা। ভারতের স্বাধীনতা পা রাখবে ৭০ তম বছরে। ৭ দশকে অনেক পাওয়া অনেক হারিয়ে যাওয়া ভারতের ছিল। দেশ যেদিন স্বাধীন হয়েছিল সেদিন তো নিজের অঙ্গচ্ছেদের বেদনা নিয়ে নতুন ভোর দেখেছিল ভারত। 'পাকিস্তানের স্বাধীনতা যেখানে অস্ত যায়, সেই ভোরেই উদয় হয় ভারতের স্বাধীনতা'। আমার ভারত, আমাদের ভারত জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে...। ব্রাজিলের রিও হঠাৎ হয়ে উঠবে লাল কেল্লা অথবা ত্রিপুরা যেখান থেকে দীপা এতটা পথ এসেছে। এমনটা হওয়ার অপেক্ষাই তো ছিল আমার, আপনার, সবার।
মঞ্চ তৈরি। রিও অলিম্পিকে মহিলাদের জিমন্যাস্ট ইভেন্টে যে ৮ জন প্রতিদ্বন্দীতা করবেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ভারতকন্যা দীপা কর্মকার। ত্রিপুরার মেয়ে দীপা হঠাৎ যেন ভারত মায়ের একমাত্র কন্যা হয়ে উঠেছে। ইতিহাসে প্রথমবার ভারতীয় কোনও মহিলা অলিম্পিক জিমনাস্টের ফাইনালিস্ট। শেষের দিক থেকে তিন নম্বরে দীপা ভল্ট নেবেন। শেষের দিক থেকে একে নেবেন আমেরিকার সিমোনে বাইলস। এক এক করে সবাই নিজেদের শ্রেষ্ঠটা দিয়ছেন। এবার দীপার পালা। কোটি কোটি চোখ। টেলিভিশনের পর্দাই যেন রিও। চোখ না বোজা ভারত তাকিয়ে দীপার দিকে। তাকিয়ে গোটা বিশ্ব। প্রথমবার দীপা সিদ্ধান্ত নিলেন প্রদুনোভা ভল্ট প্রথমেই দেবেন না, সেটা দেবেন দ্বিতীয়বারে। কারণ প্রথমেই যদি কোনও রকম প্রদুনোভায় গণ্ডগোল হয় তাহলে দ্বিতীয়বার সুযোগ থাকবে না। সেখানেই শেষ হবে রিও যাত্রা।
খালি পায়ে দীপা দাঁড়িয়ে। দৌড় শুরু করলেন। দৌড়, দৌড় তারপর একটা ঝাঁপ, শূন্যে উড়ে যাওয়া, তারপর লাট্টুর মত পাক, বাজপাখির মত ল্যান্ডিং। দ্বিতীয় বার। আবার সেই একই জায়গায়। তবে 'ডিফিকাল্টি ৭' (জিমন্যাস্টের ভাষায়) নিয়ে প্রদুনোভার জন্য দৌড় শুরু করেছেন দীপা। এর আগেই প্রোদুনোভা দিতে গিয়ে অল্পের জন্য জীবন বাঁচিয়ে ফিরেছিলেন উজবেকিস্তানের ওসাকা চুসোভিতানা। মাথাটাকে কোনও রকম ভারসাম্যের ওপর রেখে মারাত্মক চোট থেকে নিজেকে বাজিয়েখেছেন। দীপার কী হবে? উৎকণ্ঠা! আরও উৎকণ্ঠা। 'ডেথ অব ভল্ট'। ১৫ বছর ধরে যে অনুশীলন তাই এবার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মঞ্চে করে দেখাতে হবে। 'কাম অন দীপা, ইউ হ্যাভ টু ডু ইট'। ১৩০ কোটির স্লোগান ভারতের আকাশ হয়ে ব্রাজিলে আছড়ে পড়ছে কোনও এক 'দীপানোভা ঝড়ের' নাম নিয়ে। দীপা দৌড় শুরু করেছেন। আরও গতি। একটা লাফ, দীপা শূন্যে। দীপার শরীর যেন তুলোর থেকেও হালকা। দীপা যেন গোটা ভারতের হৃদয়কে বানিয়েছেন মেঘ। দীপা শূন্য থেকে মাটিতে নিজেকে যখন নামালেন, পা রাখলেন সেন্টার লাইনে একটু খানি ছুঁয়ে গেল তাঁর শরীরও। দীপা কি পারলেন? হ্যাঁ। তখনও পর্যন্ত দীপা 'বিশ্বের দুনম্বর',(সিমোনে বাইলস তখনও দাঁড়িয়ে দেখছেন, জেতা হয়ে গিয়েছে রিওর একটা স্বর্ণপদক) রূপোর পদক আসবে যদি একটু এদিক ওদিক হয় (পয়েন্ট ১৫.০৬৬)। তবে তা হয়নি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জিমন্যাস্টের খেলা তখনও বাকি। আমেরিকার সিমোনে বাইলস। নিজের ছোট্ট চেহারাকে কাজে লাগিয়ে সেরা হলেন তিনিই। দ্বিতীয় হলে রাশিয়ার মারিয়া পাসেকা। আর তৃতীয় হলেন সুইস জিমন্যাস্ট জিওলিয়া। বিশ্বের চার নম্বর হলেন ভারতের এক নম্বর।
হার না জয়? অলিম্পিকের মত মঞ্চে এক, দুই, তিন এই তিনটি সংখ্যার পর সবটাই 'নন এক্সিস্টিং'। অস্তিত্ব নেই যার! এতো কিছু জয় করে আসা সবকটা চড়াই উতরাই একটা মহাকাব্য হতে পারত, হল না, একটুর জন্য। ইশ! মনে পড়ে জয়দীপ কর্মকারের কথা? আরও এক বঙ্গসন্তান। লন্ডন অলিম্পিকে শুটিং ইভেন্টে ৪ নম্বরেই শেষ করেছিলেন জয়দীপ। কেউ মনে রেখেছেন? মিলখা সিং, পিটি ঊষা, অভিনব বিন্দ্রারা 'দ্য গ্রেট শো অব দ্য ইউনিভার্স'-এ চার নম্বর হয়ে মনে জায়গা করে নিতে পারেননি। সময় যত এগিয়েছে ভুলো মন আরও বেশি করে ভুলতে শিখেছে। 'যা গেছে তা যাক'। ইতিহাস থেকে কেউ টেনে এনেছি কি সেই গ্লোরি? আনলেও বা কতখানি? দীপাও কী তাহলে সেই তালিকায় আরও একটা নাম। নাকি দীপা মনে থাকবেন স্রষ্ঠা হিসেবে? ৪ নম্বরে শেষ করা কখনই হার নয়। বরং বিরাট জয়। দীপা আরও একটা নাম না হয়ে একটা অস্তিত্ব হয়ে থাকবেন।
সিমোনে বাইলস যখন পদক জিতে বলছেন, "আমি দ্বিতীয় বোল্ট নই। আমি দ্বিতীয় ফেল্পসও নই। আমি প্রথম সিমোনে বাইলস", তখন দীপার গলায় দীপ্তমান, "১৩০ কোটির কাছে ক্ষমা চাইছি। আমি তোমাদের স্বপ্ন সফল করতে পারিনি। নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে, কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছি না। কিন্তু আমার চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। সম্ভব হলে ক্ষমা কর"। এই উক্তির পর লেখা আর এগোচ্ছে না...কলম থমকে দাঁড়িয়ে...অসংখ্য সাদা পাতা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে, দীপার মহাকব্য লেখার অপেক্ষায়।
Hello everyone, very happy to connect with you all today through my team. Happy Independence Day! pic.twitter.com/6AW11EPPRe
— Dipa Karmakar (@DipaKarmakar) August 15, 2016