একটা সোনার পদকের জন্য মৃত্যুর ভল্টেও রাজি!
সৌরভ পাল
একটা সোনা। একটা সোনা দাও। বদলে নিয়ে নাও গোটা একটা তরতাজা জীবন। ১২৫ কোটির দেশ অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করবে আর শূন্য হাতে ফিরে আসবে? এমনটা হতে নেই! ভারত তিনটে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিততে পারে, অলিম্পিকের জিমন্যাস্ট ইভেন্টে একটা সোনা আনবে না! ছিঃ! ছিঃ! লজ্জায় মুখ যেন পা হয়ে যায়। ঢুকে থাকে জুতোর ভিতর। ভারত এই লজ্জার থেকে বরং রিওর অলিম্পিকে একটা মৃত্যু দিয়ে আসুক। যতদিন অলিম্পিকের গৌরব নিয়ে আলোচনা হবে, ভারতীয় জিমন্যাস্টের মৃত্যুও থাকবে রিং অব গ্লোরির সঙ্গেই। যেভাবেই হোক, সোনা আমাদের চাই।
গীতায় লেখা থাকবে "আত্মহত্যা মহাপাপ", রাস্তায় রাস্তায় নীল সাদায় লেখা হবে "সাবধানে গাড়ি চালান, জীবন বাঁচান", আর অলিম্পিকে ঠিক উল্টো, 'যায় যদি যাক প্রাণ, অলিম্পিকের সোনা ভগবান'। সবাইকে বাঁচিয়ে দীপাকে 'আত্মহত্যা'র দিকে ঠেলে দেওয়া, একটা রিও অলিম্পিকের পদকের জন্য! বিচিত্র মহাকাশ এই দেশ!
একটা ভল্ট দিয়েই বাঙালি দীপা কর্মকার হয়ে উঠলেন বিশ্বজনীন 'দীপানোভা'। ১৯৯৯ সালের পর ২০১৬- ১৭ বছর পর রাশিয়ার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছেন এক বাঙালি। বঙ্গ আর বাঙালির রাশিয়া প্রেম আজকের নয়। 'ইস্পাতের ফুল' স্ট্যালিন-যোগ বরাবরই ছিল এবং আছে বাঙালির মনে। রুশ বিপ্লব বাঙালি ভুলে যাবে? তবে জিমন্যাস্টে রাশিয়ার সঙ্গে বাঙালি কন্যার এক হয়ে যাওয়া কেবল কাকতালীয় নয়। মৃত্যুর লড়াই আর জয়, মিলিয়ে দিল রুশ আর বাঙালিকে। মৃত্যুকে জয় করেই ফিরতে হবে দীপাকে। আত্মহত্যার চেষ্টা করতে হবে, আবার মৃত্যু জিতে সোনার পদক বুকে ঝুলিয়ে ভারতের মাটিতে ফিরতে হবে।
প্রোদুনভা ভল্ট দিয়েই ইতিহাসে ঢুকে পড়েছেন দীপা কর্মকার। ইতিহাসে ঢুকলেই তো হবে না, ইতিহাসে ভারতের ঝান্ডা গেড়েই ফিরতে হবে। ১৪ আগস্ট রাতে যখন রিওতে আরও এক মৃত্যু ভোল্ট দেবেন দীপা, ভারত তখন অপেক্ষা করবে আরও এক স্বাধীনতা দিবসের। অপেক্ষা করবে হয় আত্মহত্যার খবরে শিরোনাম ভরার অথবা সেদিন তেরঙ্গা উঠবে ব্রাজিলেও। তবুও কেউ বলবে না, দীপা তুমি আত্মহত্যা করো না! উল্টে এটাই তো সাহস। এটাই দীপা। দীপা তুমি এগিয়ে যাও, একটা সোনা নিয়ে এসো, আমরা তোমার পিছনে আছি বলে আকাশমুখী স্লোগান দেবে ভারত। অ্যামেরিকান তারকা জিমন্যাস্ট সিমোনে বাইলস যেখানে বলবেন, "আমি মরতে চাই না, তাই প্রোদুনভা ভল্ট দেব না", সেখানে ১২৫ কোটির ভারত বলবে, দাও দাও, ওটা হলেই সোনা বাধা।
জিমন্যাস্টিকের জগতে প্রদুনোভা ভল্টকে বলা হয় "দ্য ভল্ট অব ডেথ"। সবথেকে বিপদজনক। ফ্রন্ট হ্যান্ডস্প্রিং এবং তার ওপরে দুটো ফ্রন্ট সামারসল্ট। রাশিয়ান জিমন্যাস্ট ইয়েলেনা প্রোদুনোভা ১৯৯৯ সালে প্রথম এই ভল্ট দিয়েছিলেন এবং তাঁর নামের অনুকরণেই এই ভল্টকে বলা হয় প্রোদুনোভা ভল্ট। এই ভল্টেই সবার নজর, সব দেশের নজর। রিও অলিম্পিকে দীপাই একমাত্র যিনি এই ভল্ট দেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। কীভাবে দীপা আয়ত্ত করলেন প্রোদুনোভা ভল্ট? ভাঙা স্কুটারের যন্ত্রাংশ নিয়ে স্প্রিংবোর্ড তৈরি করে প্রথম প্রোদুনোভা ভল্টের অনুশীলন। মৃত্যুটা সেদিনই হতে পারত। হয়নি, সেই যে ভয় কাটিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন, তারপর টানা ১৫ বছর প্রোদুনোভা ভল্টের সঙ্গেই প্রেম দীপার। এখন এই সম্পর্কের একটা সামাজিক স্বীকৃতির জন্য উঠে পড়ে লেগেছে গোটা দেশ। চাই অলিম্পিক পদক।
'তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার পদক চাই'। প্রথম বাঙালি ভারতীয় মহিলা হিসেবে 'বিগেস্ট শো অব দ্য আর্থ'-এ ইতিহাস তৈরি করলেই হবে না, চাই আরও। এটা আত্মহত্যা নয়? আত্মহত্যার প্ররোচনা নয়? আমি বলছি হ্যাঁ। কেন বলছি? ভারত ক্রিকেটে কত টাকা খরচ করে? ভারত দাবায় কত টাকা খরচ করে? ভারত ফুটবলে কত টাকা খরচ করে? ভারত হকিতে কত টাকা খরচ করে? ভারতের আর্থিক বাজেটের কতটা পরিমাণ অংশ এই জিমন্যাস্টের জন্য বরাদ্দ? কিছুই দেব না, আর সব চাই! এই আমার দেশ।
তুমি ফিরে এসো দীপা!
ব্যালান্সিং বিম থেকে তোমার লাফিয়ে যাওয়া শূন্যে, বাজপাখির মত তোমার ল্যান্ডিং, শুন্যে তোমার লাট্টু হওয়া, সোনা রূপো কিংবা ব্রোঞ্জের থেকেও বেশি কিছু। স্বর্গীয়!