পঞ্চাশের দুনিয়ায় সচিনের সেরা এগারো
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর। একদিনের ক্রিকেটে তাঁর জাতীয় দলের জার্সি তুলে রেখে দিয়ে গেলেন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। ৫০ ওভারের এই ক্রিকেটীয় ফর্মাটে ৪৯টি সেঞ্চুরি আর ১৮,৪২৬ রানের মালিকের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যে কোন আলোচনাই চরম বাতুলতা মাত্র। মাস্টার-ব্লাস্টারের অগণিত অবিস্মরণীয় ইনিংসের মধ্যে আমাদের মতে সেরা এগারো।
১. ১৪৩ রান, বিরুদ্ধে অস্টেলিয়া, শারজা (১৯৯৮): চাপের মুখে ব্যর্থ হন সচিন তেন্ডুলকর। নিন্দুকদের এই দাবিকে স্ট্রেট ডাইভে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের নতুন নিশান কায়েম করেছিলেন সচিন, শারজাতে, কোকাকোলা কাপে। সেমিফাইনালে বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া নির্ধারিত ৫০ ওভারে করেছিল ২৮৮। এই ম্যাচ সরাসরি জিতলে বা ক্রিকেটের কঠিন অঙ্কের নিয়মে ৩০ রানে বিপক্ষের কাছে হারলে ফাইনালের টিকিট পকেটে পুরতে পারবে ভারত, এরকম অবস্থায় প্রথমেই ভারতের ব্যাটিং বিপর্যয় শুরু হয়। বাড়তে থাকে আস্কিং রেট। বাদ সাধে প্রকৃতিও। শারজার কুখ্যাত মরু ঝড়ের প্রকোপে ভারতের টার্গেট আর একটু কঠিন হয়ে যায়। ৮৭ রানে প্রয়োজন ৯৪ রান, এরকম অবস্থায় দলের হাল ধরেন সচিন। তারপরের বাকিটা ইতিহাস। সমগ্র শারজা সাক্ষী থাকে সচিন ঝড়ের। যার প্রকোপে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় শক্তিশালী গোটা অসি বোলিং বাহিনী। সচিনের সেদিনের ১৪৩ রানের ঝোড়ো ইনিংস হয়ত সেদিন ভারতকে জয়ের দোরগোরায় পৌঁছে দিতে পারেনি, কিন্তু দলের জন্য ফাইনালের দরজাটা খুলে দিয়েছিল।
২. ২০০ রান, বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা, গোয়ালিয়র (২০০৪): একদিনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সচিনের আর এক মাইলস্টোন। ক্রিকেটের এই ধরণের ফর্মাটেও দ্বিশতরান করা সম্ভব তাই প্রমাণ করেছিলেন সচিন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার অসহায় বোলাররাও বোধহয় পরাজয় ভুলে গিয়ে ২২গজে মাস্টারব্লাস্টারের এই অসামান্য রুস্তমিকে মনে মনে কুর্ণিশ করে ছিলেন সেইদিন।
৩. ১৪০ রান, বিরুদ্ধে কেনিয়া, ব্রিস্টল (১৯৯৯): ১৯৯৯-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ। দক্ষিণ আফ্রিকা আর জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে পরপর দুটো ম্যাচে শোচনীয় পরাজয়ের পর ধুঁকছে গোটা ভারতীয় দল। এর মাঝেই আর এক বিপর্যয়। অকস্মাৎ পিতৃবিয়োগের খবরে জিম্বাবোয়ে ম্যাচের আগেই দেশে ফিরে গেছেন দলের ব্যাটিং স্তম্ভ সচিন তেন্ডুলকর। বিশ্বকাপে টিকে থাকতে গেলে জিততেই হবে কেনিয়া ম্যাচ। পিতৃশোক সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন সচিন। দেশের প্রতি, ক্রিকেটের প্রতি তাঁর অতুলনীয় অধ্যাবসায়ের নজির গড়ে তুললেন। তাঁর ব্যাটের কাছে খড়কুটোর মত উড়ে গেল কেনিয়ার সমস্ত প্রতিরোধ। দেশকে এনে দিলেন অতি প্রয়োজনীয় জয়। শতরান উৎসর্গ করলেন বাবার প্রতি।
৪. ৯৮ রান, বিরুদ্ধে
পাকিস্তান, সেঞ্চুরিয়ন (২০০৩): বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপরাজেয় খেতাবটা ২০০৩-এ বজায় রেখেছিল ভারত। সৌজন্যে সচিন তেন্ডুলকর। তাঁর ৮৭ বলে করা ৯৮ রানের ইনিংসের কাছে প্রথম থেকেই দিশাহীন সচিন। ফাইনাল আর পাকিস্তানের মাঝে সচিন তেন্ডুলকর নামক চিনের প্রাচীরকে টপকে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের স্বাদ পাওয়া হল না শোয়েব আখতারদের।
৫. ৯০ রান, বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া, মুম্বই (১৯৯৬): তর্কাতীত ভাবে `৯৬ বিশ্বকাপে সচিনের সেরা ইনিংস। বিপক্ষে ম্যাকগ্রা, শেন ওয়ার্নের মত রথী-মহারথীরাও লিটল মাস্টারের ব্যাটের কাছে নতজানু হয়েছিলেন। আগের ইনিংসে মার্ক ও-র করা সেঞ্চুরিও ফিকে হয়ে গিয়েছিল সচিনের ৯০-এর কাছে।
৬. ১৪১ রান, বিরুদ্ধে পাকিস্তান, রাওয়ালপিন্ডি (২০০৩-২০০৪): কিছুদিন ব্যাডপ্যাচে ভুগছিলেন সচিন। সুযোগ বুঝে সমালোচকরা বলতে শুরু করেছিলেন রিফলেকসন হারাতে শুরু করেছেন মাস্টারব্লাস্টার। কিন্তু সচিন জানেন সব সমালোচনার উত্তর তাঁর ব্যাটেই লুকিয়ে আছে। আর সেই সবকিছুর জবাব দি তেই বোধহয় বেছে নিয়েছিলেন পাক বোলিং স্কোয়াডকে। বিপক্ষের ৩৩০ রানের বিশাল স্কোরের চাপে যখন দিশাহারা ভারতীয়রা ঠিক তখনি জলে উঠেছিল তাঁর ব্যাট। সচিনের ১৩৭ বলে ১৪১ রানের সেই ইনিংস হয়ত ভারতকে কাঙ্খিত জয় এনে দিতে পারেনি কিন্তু সচিন আর একবার প্রমাণ করেছিলেন আধুনিক ক্রিকেটের ব্যাটিং শব্দটার শেষকথা তিনিই।
৭. ১৭৫ রান, বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া, হায়দরাবাদ (২০০৯): জয়ের জন্য ৩৫১ রান তাড়া করতে নেমে সচিনের এই ইনিংসটাকে ওয়ানডে ক্রিকেট অন্যতম সেরা ট্র্যাজিক ইনিংস হিসাবে ধরা হয়। ১৪১ বলে ১৭৫ রানের এই ইনিংসটা সাজানো ছিল ১৯টা বাউন্ডারি আর চারটে ওভার বাউন্ডারি দিয়ে। বলাটা ভুল হল আসলে সচিনের এই ইনিংসটা সাজানো ছিল লড়াই আর শিল্পের অদ্ভুত মেলবন্ধনের প্রতীক হিসাবে। না, সেদিন সচিন অল্পের জন্য একা হাতে দেশকে জেতাতে পারেননি। কিন্তু তাতে কি সচিন তো ক্রিকেটকেই জিতিয়ে দিয়েছিলেন সেই ইনিংস খেলে।
৮. ৮২ রান, বিপক্ষে নিউজিল্যান্ড, ইডেনপার্ক, অকল্যান্ড (১৯৯৪): একদিনের ক্রিকেটে ওপেনার হিসাবে আত্মপ্রকাশ। সম্ভবত ভারতীয় ক্রিকেটে নভজত সিং সিধুর সেরা অবদান। তিনি ম্যাচ থেকে সরে দাঁড়ানোয় ওপেনার হিসাবে মাঠে নামেন সচিন। মাত্র ৪৩ বলে উফার দেন ৮২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস। সচিনের নিজের মতে `এই রকম ইনিংস জীবনে একবারই সম্ভব।` এরপর বোধহয় এই ৮২ রান নিয়ে আর কোন বাক্যব্যায়ের প্রয়োজন থাকে না।
৯. ১৩৯ রান, বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোর: শ্রেষ্ঠত্বের আরও একটা নিদর্শন। একদিনের ক্রিকেটে প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে ১০,০০০ রানের ক্লাব প্রতিষ্ঠা। প্রথম সদস্যও তিনি। সবুজ ব্যাগি টুপির মালিকদের উপর কর্তৃত্ব করে রীতিমত রাজকীয় ভঙ্গিতে নিজের ২৮তম সেঞ্চুরিটিও সেরে ফেলেছিলেন ওইদিন।
১০. ১৮৬ রান, বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ড, হায়দরাবাদ (১৯৯৯-২০০০): অপরাজিত দ্বিশতরানের আগে একদিনের ক্রিকেটে সচিনের সর্বোচ্চ রান। দেড়শ বলে করা লিটল মাস্টারের ১৮৬ রানের এই ইনিংসটি সম্ভবত সচিনের জীবনের সবথেকে নিখুঁত ওয়ানডে ইনিংস। ক্রিকেট ব্যাকরণের বাইরে একটিও শট খেলেননি সেদিন। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব তো এর অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু তিনি যে ক্রিকেট স্কুলের একনিষ্ঠ ছাত্র তারই প্রমাণ হায়দরাবাদের এই ইনিংস।
১১. ১২০ রান, বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড, (২০১১ বিশ্বকাপ, বেঙ্গালুরু): সচিন তেন্ডুলকরের ক্রিকেটীয় জীবনের সেরা পাওনা সম্ভবত ২০১১ বিশ্বকাপ জেতা। আর সেই বিশ্বকাপেই এই ইনিংস খেলে সচিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কাপ জিততে কতটা মরিয়া। সচিনের এই অনবদ্য ইনিংসের সৌজন্যে ভারত করে ৩৩৮ রান। সেই ম্যাচ অবশ্য টাই হয়ে যায।