বিধ্বস্ত সুন্দরবন, ৮০ লাখেরও বেশি ব্যবসায় ক্ষতি, দু'মুঠো খেয়ে বাঁচার পথ খুঁজছেন মৎস্যজীবীরা
এখন সারাদিন খুঁজলেও এক-একজন মৎস্যজীবী এক থেকে দেড় কিলোর বেশি কাঁকড়া ধরতে পাচ্ছেন না, যেখানে ঝড়ের আগে এক-একজন মৎসজীবী গড়ে ১৫ কেজি করে কাঁকড়া ধরতেন।
অধীর রায় ও প্রসেনজিৎ সর্দার : সুন্দরবনের উপর দিয়ে আমফান বয়ে গেছে দু সপ্তাহ হয়ে গেল। তারপরে এখানকার মানুষের দুর্ভোগ যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে । নদীর বাঁধের উপর ত্রিপল টানিয়ে কোনওরকমে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করলেও সংকট দেখা দিয়েছে খাদ্যের । সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন মৎসজীবীরা । আর সমস্যা চরম আকার নিয়েছে আমফানে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে।
ম্যানগ্রোভ-মৎসজীবীর সম্পর্ক
সুন্দরবনের গোসবা, বাসন্তী, ঝড়খালি,ক্যানিংয়ে বিভিন্ন নদী বাঁধের কাছে ও নদীর খাঁড়িগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ম্যানগ্রোভ গাছ থাকে। সেই গাছগুলোর নীচে বা আশপাশে প্রচুর কাঁকড়া পাওয়া যেত। কিন্তু আমফানের পর সেই ছবি অতীত হয়ে গিয়েছে। মৎস্যজীবী তপন গায়েন জানান , "আমফানের দাপটে ম্যানগ্রোভ গাছের ব্যাপক পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে। ছোট ছোট ম্যানগ্রোভ গাছগুলি নদীর ঢেউয়ের দাপটে হারিয়ে গেছে। যার ফলে ম্যানগ্রোভ গাছও নেই, আর কাঁকড়ার দেখাও মেলে না। এখন সারাদিন খুঁজলেও এক-একজন মৎস্যজীবী এক থেকে দেড় কিলোর বেশি কাঁকড়া ধরতে পাচ্ছেন না, যেখানে ঝড়ের আগে এক-একজন মৎসজীবী গড়ে ১৫ কেজি করে কাঁকড়া ধরতেন। এরফলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রচুর মৎস্যজীবী।
কাঁকড়ার আন্তর্জাতিক চাহিদা
দিন পনেরো আগে আমফান সুন্দরবনের মৎসজীবীদের আয়ের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিলেও, পেরেক পোঁতা শুরু হয়ে গিয়েছিল ২ মাস আগে যেদিন থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে তখনই। সারা বছর প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক থেকে দেড় কুইন্টাল কাঁকড়া ধরতেন মৎসজীবিরা । সেই কাঁকড়ার প্রায় ৯৫ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি করা হত। সবচেয়ে বড় মার্কেট ছিল চিন। এরপর ইরান, জাপান, কোরিয়া সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাঁকড়া রপ্তানি করা হত। কিন্তু করোনাভাইরাসে জেরে গোটা পৃথিবী জুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ার পর, বিদেশে রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে এই কাঁকড়ার ব্যবসা। এরপর আমফানের তাণ্ডব। সব মিলিয়ে সর্বস্বান্ত সুন্দরবনের মৎসজীবীরা।
ক্ষতির পরিমাণ
প্রথমে লকডাউন, তারপর সুপার সাইক্লোন আমফান । দুটো বিপর্যয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন সুন্দরবনের প্রচুর মৎস্যজীবী। লকডাউন এর কারণে ২ মাস ধরে সুন্দরবনের কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় মৎসজীবীরা জানান, "সুন্দরবনের কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কাঁকড়া মজুত করা থাকে। কিন্তু আচমকা লকডাউন শুরু হয়ে যাওয়ার ফলে অর্ডার থাকা স্বত্ত্বেও কাঁকড়া বিদেশে পাঠাতে পারিনি । সেই মজুত কাঁকড়া মরে গিয়ে প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে।" এটা শুধু কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করতে না পারার দরুণ ক্ষতির পরিমাণ। এর বাইরেও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে সুন্দরবনের মৎসজীবীদের। বিশেষ করে কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের। তাঁরা জানান, "বিদেশে কাঁকড়া না পাঠানো ক্ষতির একটা দিক। অন্যদিকটা হল বাইরে থেকে সুদে টাকা ধার করে এনে ব্যবসায় লাগালাম, এদিকে ব্যবসা হল না। ফলে আয় নেই, কিন্তু প্রতিমাসে সুদ গুনতে হবে।" ব্যবসা শুরু করার আগেই লকডাউন ও আমফান ছারখার করে দিয়ে গেল সুন্দরবনের মৎস্যজীবী থেকে অনেক কাঁকড়া ব্যবসায়ীকে।
মৎসজীবীদের ভবিষ্যৎ
সুন্দরবনে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বসবাস করেন। অধিকাংশ পরিবারের আয়ের উৎস মৎস্যচাষ। এখন কি সবাই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসোনোগ্রাফি বিভাগের ডিরেক্টর তুহিন ঘোষ জানান, "সুন্দরবনে ২ ধরনের মৎসজীবী আছেন । একদল সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। আরেকটি দল নদীতে মাছ ধরেন । যারা সমুদ্রে মাছ ধরতে যান তাদের ক্ষতি সাময়িক। এই ক্ষতি সামলে নেওয়া যাবে । কিন্তু যাঁরা নদীতে মাছ ধরেন, তাঁদের ক্ষতি অপরিসীম । নোনা জল ঢুকে পড়ায় মাছ এবং কাঁকড়া সব মরে গিয়েছে । কাঁকড়া এখানে কত লোক আর খায় । সবটাই রপ্তানি হয় । লকডাউন আর আমফানের ফলে এই মৎসজীবীরা এখন চরম সঙ্কটে। সুন্দরবনের মানুষ ঝড়কে ভয় পায় না। ভয় পায় বাঁধ ভাঙাকে। কারণ নদীতে নোনা জল ঢুকে গেল না খেতে পেয়ে মরে যাবে এখানকার লক্ষাধিক মানুষ।" একদিকে লকডাউনে কাঁকড়া রপ্তানিতে তালা, অন্যদিকে আমফানের দাপটে ম্যানগ্রোভ গাছের ক্ষতি। পাওয়া যাচ্ছে না কাঁকড়া। জোড়া ফলায় শাঁখের করাত অবস্থা সুন্দরবনের মৎস্য ও কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের।
আরও পড়ুন, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে করোনা আক্রান্ত আরও ৪৪৯, মৃত্যু ১৩ জনের