হল অফ শেম ২০১৪
বছর ভর এমন কিছু ঘটনা ঘটল যা দিয়ে অনায়াসে তৈরি করে ফেলা যায় একটা 'হল অফ শেম'। ২০১৪ সালের জন্য যদি হল অফ শেম তৈরি করা হয় তাহলে এরা বা এগুলো অবশ্য ঠাঁই পাবে। ১৪ সালের ১৪টি হল অফ শেমের মূর্তি তৈরি হল নিচের প্রতিবেদনে--
পার্থ প্রতিম চন্দ্র
বছর ভর এমন কিছু ঘটনা ঘটল যা দিয়ে অনায়াসে তৈরি করে ফেলা যায় একটা 'হল অফ শেম'। ২০১৪ সালের জন্য যদি হল অফ শেম তৈরি করা হয় তাহলে এরা বা এগুলো অবশ্য ঠাঁই পাবে। ১৪ সালের ১৪টি হল অফ শেমের মূর্তি তৈরি হল নিচের প্রতিবেদনে--
১৪) নগ্ন হ্যাকার- এদের নিয়ে হয়েছে এক জ্বালা। কোথাও সবাইকে রাখঢাক করে নিজেকে খুলে রাখবেন তা না একেবারে ফাঁস করে দিচ্ছেন এরা। ইন্টারনেট আসার পর হ্যাকররা জাতটা আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে। যে দেশের হ্যাকার যত এক্সপার্ট সে দেশ তত উন্নত। তা সেই হ্যাকরদের মধ্যে একদল হলেন নগ্ন হ্যাকার। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন তাদের কাজ হচ্ছে নামজাদা সব সেলেবদের নগ্ন ছবি ফাঁস করা। গত সেপ্টেম্বরের গোড়ায় জেনিফার লরেন্স, কিম কার্দাশিয়ান, সেলেনা গোমেজ, রিহানা সহ একসঙ্গে শতাধিক হলিউড সেলেবদের একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি ফাঁস করে গোটা বিশ্বের কাছে ছি ছি কুড়িয়েছেন হ্যাকররা। তবে কী গোপনে কেউ কেউ পিঠও চাপড়েছেন তাদের। কিন্তু হল অফ শেম এইসব হ্যাকারদের স্থান একেবারে পাকা।
১৩) আন্তর্জাতিক বক্সিং ফেডারেশন- কথায় বলে না নিজের দোষ ঢাকতে অন্যকে কামড়ে দেওয়া। সেটাই হয়েছে আন্তর্জাতিক বক্সিং ফেডারেশনের। এশিয়ান গেমসে সরিতা দেবী পদক ফিরিয়ে দিয়ে অন্যায় করেছেন সেটা মানা গেল, কিন্তু যে নির্লজ্জভাবে সেমিফাইনালে রেফারি সরিতাকে হারিয়ে দিলেন সেটা কী হল! সরিতাকে আয়োজক দেশের বক্সারকে জেতাতে রেফারির অন্যাকাজটা চোখ ঢেকে রেখে যত দোষ নন্দ ঘোষের মত মনিপুরী বক্সারকে গায়ে এসে পড়ল। আর সেই রেফারি পুরস্কৃত হলেন। তাই আর কী এক ঘুসি মেরে হল অফ শেমে আন্তর্জাতিক বক্সিং ফেডারেশন।
১২) দুর্নীতি- যে কোনও বছরেই ইনি হাঁটতে হাঁটতে হল অফ শেমে ঢুকে পড়েন। কিন্তু এ বছরটা আরও একটু স্পেশাল। দক্ষিণের জয়ললিতা থেকে পূর্বের সারদা রাজ। দুর্নীতি চলছেই। আন্না লড়াই শুরু করেছিলেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট সেই আন্দোলনকে ঝড়ে পরিণত করেছিলেন। দায়িত্ব নিয়ে কেজরিওয়াল তাতে মোটামুটি জলও ঢেলে দিয়েছেন। কিন্তু দেশে দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। অবশ্য লোকসভা নির্বাচনে আম জনতা বুঝিয়ে দিয়েছে 'তুমি দুর্নীতি কর, আমি ইভিএমে জবাব দেব।'
১১) ব্রাজিলের সাত গোল- দেশের মাটিতে স্বপ্নের বিশ্বকাপ খেলতে নেমে ব্রাজিল একেবারে লজ্জা উপহার দিল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেমিফাইনালে উঠে বেলো হরিজান্তেতে লুই ফিলিপ স্কোলারির ব্রাজিল ১-৭ গোলে হারল জার্মানির বিরুদ্ধে। ফুটবলের দেশে এত বড় লজ্জা হল অফ শেমে থাকবেই।
১০) সস্তা প্রচার- সস্তা প্রচার পাওয়ার একেবারে মূর্তিমান বছর হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে ২০১৪। কেউ পাত্তা দিচ্ছে না, সবাই ভুলে গেছে ওমনি এমন একটা কাজ কর যা দেখে গৃহস্থ বলবে ছ্যা, ছ্যা..ওই যে কিম কার্দাশিয়ান যেমন, খবরে আসতে হবে তাই আর কী! সব কিছু পোশাক বর্জন করে, শরীরকে পিছন করে তেল মেখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে পড়া, সব কিছু খুলে বিভত্স ভঙ্গিতে সেলফি তোলা। মিলি সাইরাস আবার সস্তা প্রচার পেতে পোশাক যেখানে সেখানে খুলে ফেলেন, কখনও আবার জিভ কালো করে ফেলেন। আর আমাদের বলিউড তো ২০১৪ সালে সস্তা প্রচারে পিএইচডি করে ফেলেছে। আজ শুনবে ও ওকে ঘুসি মেরে দিল, তো কালই আবার ওর বোনের বিয়েতে সে কী চুমু খাওয়া। ছবি রিলিজের আগে ঝগড়ার নাটক, স্ক্রিপ্ট চুরির গল্প এসব তো রয়েইছে। ছবি মুক্তি পেয়ে গেলেই সব বিতর্ক শেষ। আর ছোটখাটো পোশাক পরে সস্তা প্রচারের জন্য তো পুনম, শার্লিনরা রয়েইছেন।
৯) শ্রীনিবাসন অ্যান্ড কোং- তাঁর কীর্তি দেখে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছে, আপনি তো খেলাটার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন। মুদগল কমিটি থেকে কোর্ট যতই তাঁর বিরুদ্ধে আঙুল তুলুন শ্রীনিবাসন কিন্তু একেবারে আকঁড়ে পড়ে রয়েছেন, যে কায়দায় দ্রাবিড় দাঁত কামড়ে ক্রিজে পড়ে থাকতেন হুবহু সেই কায়দায়। এর মাঝে আবার কায়দা করে আইসিসি-র শীর্ষ পদটাও হাসিল করে ফেলেছেন। তবে কী ক্রিকেটের সর্বানাশ করার কিছু পন্থা তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। একখান জামাই করেছেন বলার মত, তারওপর তাঁর বামা হাত ডান হাতে বিন্দু, রাজের মত সব সেনাপতিরা। বছরের হল অফ শেমে তিনি আর তাঁ। টিম উঠবেন না তো কী....উঠবো!
৮) কংগ্রেসের ভোটপ্রচার- এ এক কথায় অবিশ্বাস্য। হারাবি না মানে! হেরে দেখাবে। ঠিক এমনই ভোটপ্রচার ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে করেছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। নেতারা ফ্যাসফ্যাসে গলায় কী যেন বললেন সেটা শুধু তারাই জানেন। টিভিতে বিজ্ঞাপনে যখন আক্কিবার মোদী সরকার চলছে, তখন কংগ্রেসের বিজ্ঞাপনে চমক তো ছিলই না, ছিল না কিছুই। আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে যখন মোদী একেবারে নিজেকে ছেয়ে ফেলেছেন, তখন কংগ্রেসের হাতের ছাপও ফেলতে পারেনি। ফল সর্বকালের খারাপ ফল, গোটা দেশে মাত্র ৪৪টি আসন। হাত ধরে তাই কংগ্রেসের ভোটপ্রচার চলে যাচ্ছে হল অফ শেমে।
৭) প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা-- ব্যাপারটা যখন প্রকৃতিকে নিয়ে তা সে তো একটু খামখেয়ালিপনা করবেই। কিন্তু তা বলে এত! হুদহুদ নামটা শুনে যতই গুদগুদি আসুক, গোটা দেশকে হেলিয়ে দেওয়ার জন্য সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ব্যাটা। তার ওপর আবার কাশ্মীরের বৃষ্টি, ঝড়। গোটা বিশ্ব জুড়েও প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা চালু ছিল। আমেরিকায় এত ঠান্ডা পড়ল যে গোটা দেশে একেবারে কাবু হয়ে গেল। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা এবার হল অফ শেমে থাকবেই।
৬) যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ...- তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল। এসব প্রশ্নকে থোড়াই কেয়ার করে যুদ্ধ, যুদ্ধ খেলা চলছেই। প্যালেস্তাইনের জঙ্গিদের দমন করতে গিয়ে ইজরায়েল বোমা মারল প্যালেস্তাইনের ছোট বাচ্চাদের ওপর, স্কুলের ওপর, নিরীহ মানুষের ওপর। গোটা বিশ্ব জুড়ে ইজরায়েলকে নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠল। তাতে বয়েই গেল ইজরায়েলের। এ দিকে আবার গাজা, সিরিয়ায় খোলামকুচির মত বোমা পড়তে থাকল সারা বছর। ফল বহু মানুষের মৃত্যু। এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ক্লান্ত বিশ্ব এখন যুদ্ধকেই হল অফ শেমে পাঠাচ্ছে।
৫) বলিউডের ১০০ কোটি- এই একটা সংখ্যা হয়েছে বটে। ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা করলেই সিনেমা সুপারহিট। সিনেমা যেমনই হোক ১০০ কোটি হয়ে গেলেই সাত খুন মাফ। এর চক্করে ভাল সিনেমা বানাবেন উপায় নেই। প্রযোজকরা পরিচালকদের বলবেন, ১০০ কোটি দিতে পারবে! ১০০ কোটি ক্লাবে ঢুকতে হবে বলে খামোখা যৌনতা, বোকা বোকা ডায়লগও অনায়াসে পিঠ চাপাড়ানি পেয়ে যাচ্ছে। ১০০ কোটিতে খানদানি বাড়ছে কমছে ভাল ছবি বানানোর প্রয়াস। খান, কিংবা বড় বড় সুপারস্টাদের নেওয়া, তারপর একেবারে ফাটিয়ে প্রচার, তাহলেই ১০০ কোটি, না নিলে হতাশা। ছবির বিষয়, পরিচালনা সব ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বছর শেষে বাহবা পাচ্ছে 'কিক', 'ব্যাঙ ব্যাঙ', 'রাগিনী এমএমএস' আর আড়ালেই পড়ে থাকছে 'ইয়ংগিস্তান'-এর মত সিনেমা। তাই ১০০ কোটিই হল অফ শেমে।
৪) সন্ত্রাসবাদ-পাকিস্তানের স্কুলেই হোক কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ক্যাফে। বর্ধমানের খাগড়াগড় কিংবা বাগদাদের সেনাছাউনি। ২০১৪ সালে সন্ত্রাসবাদের শিকার গোটা দুনিয়া। কখনও সাংবাদিকের মাথা কেটে দেওয়া তো কখনও স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের অপহরণ। ২০১৪ সালে ছোট বড় মিলিয়ে সারা বছর প্রায় ৪০০টিরও বেশি সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তানের স্কুলে জঙ্গি হানা মারা গিয়েছে ১৩২ জন ছাত্রছাত্রী। ইসলামিক স্টেট থেকে হক্কানি নেটওয়ার্ক, বোকো হারাম কিংবা আল কায়দা, তালিবান অথবা জামায়াত ই ইসলাম। সন্ত্রাসবাদ ডান মেলছে। দুনিয়াকে সন্ত্রাসের অন্ধকার দুনিয়ায় ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা ২০১৪ সালের হল অফ শেমে ঢুকবেই।
৩) সুয়ারেজের দাঁত- একখান দাঁত বটে। কেউ কেউ বলেন ড্র্যাকুলার দাঁত। বিশ্বকাপের মাঝে এমন কামড় দিলেন যার আঘাতে লুইস সুয়ারেজের দেশ উরুগুয়ে একেবারে ধরাশায়ী হয়ে গেল। কী দরকার ছিল হঠাত্ ওভাবে ইটালির জর্জো কিয়েলিনিকে কামড় দেওয়ার। নিন্দুকরা বলেন না কামড়ালে সুয়ারেজের দাঁত নাকি সুডসুড় করে। তাই আর কী একেবারে আস্ত দু পাটি দাঁতই সাজানো থাকবে হল অফ শেমে।
২) ইবোলা ভাইরাস- বলি হারি বাবা ভাইরাস। পুচকে মাপের ভাইরাসে একেবারে গোটা দুনিয়া থড়হরি কম্পন। পশ্চিম আফ্রিকায় হাজার হাজার লোককে মেরে এখন গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার হুমকি দিচ্ছে ইবোলা ভাইরাস। মধ্য আফ্রিকার উত্তরাংশে কঙ্গোর উপত্যকায় প্রবাহিত ইবোলা নদী থেকে ইবোলাভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালে এ ভাইরাসের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়। বছরের হল অফ শেমে ইবোলা ভাইরাস একেবারে পাকাপাকিভাবে থাকবে।
১) ঠোঁটকাটারা- ঠোঁট বলি হারি বাবা। এরা মুখ খুললেই একেবারে বচন, বাণী বের হয়। 'কৃষ্ণনগরের মাল'(ওটা উনিই বলেছেন) তাপস পাল থেকে আরএসএস-এর বাধ্য কন্যা স্বাতী নিরঞ্জনা জ্যোতি। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী জিতন রাম মাঝি থেকে উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি নেতা আজম খান, বিজেপি সাংসদ যোগি আদিত্যনাথ। কিংবা আমাদের কীর্তিমান অণুব্রত মণ্ডলের পুলিসকে বোমা মারুন। এদের দায়িত্বজ্যানহীন মন্তব্য নিয়ে গোটা দেশ সোরগোল। তৃণূমূলের সাংসদ তাপস পাল বিরোধী দলের সমর্খকদের হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করে দেব। মন্ত্রী নিরঞ্জনা আবার বলেছিলেন, হয় রামজাদে না হয় হারামজাদে। ডাক্তারদের 'হাত কেটে নেওয়ার' হুমকি দিয়েছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী জিতন রাম মাঝি। মাঝিই আবার দলকে অস্বস্তি ফেলে বলেছিলেন. তিনি একদিন প্রধানমন্ত্রী হবেন।
লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড-পাকিস্তান- সারা বছর নয় সারা জীবন ধরে নানাভাবে এরা ভারতের ক্ষতি করে চলেছে। এ বছর তো কাশ্মীর সীমান্ত গুলি বারুদ দিয়ে ভারতকে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার প্রচেষ্টাও চলেছিল। সন্ত্রাসবাদকে নিজেদের পোশাক করে পাকিস্তান তাই হল অফ ফেমে লাইফ টাইম অ্যাচিভেমেন্ট পুরস্কার পাচ্ছে।