নম্বর যাদের কম, তাদের থেকেই আশা বেশি
যেসব ছাত্ররা পরীক্ষায় প্রচুর নম্বর নিয়ে পাশ করেছে, এই লেখাটি তাদের জন্য নয়। তাদের বুকে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য তো আস্ত একটা সমাজ দু’হাত বাড়িয়ে রয়েছে। বরং এ লেখা সেইসব ছেলে মেয়েদের জন্য যাদের মাথা এই মুহূর্তে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। যারা নিজেদের পরাজিত, বিপর্যস্ত বলে মনে করতে শুরু করেছে।
দয়াশঙ্কর মিশ্র
মোবাইল, ফেসবুক জুড়ে শুধু ওদেরই ছবি। এমনকী, খবরের কাগজের পাতাতেও বড় বড় অক্ষরে ছাপা নামগুলো। এটাই তো স্বাভাবিক। দশম শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ওরাই তো এখন যত্র তত্র সর্বত্র। ওরা, মানে যারা দশম শ্রেণির গণ্ডি পেরিয়েছে মাইলফলক তৈরি করে। ওরা, যাদের নম্বরের ভাঁড়ার টইটুম্বুর। দশম শ্রেণির সেইসব শীর্ষস্থানীয় ছাত্রছাত্রীরা এখন বাবা—মায়ের কাছে অনুপ্রেরণার আরেক নাম। কিন্তু জানালা দিয়ে উঁকি মেরে সমাজ দেখা এই পরিবারগুলো বুঝতে পারছে না, এই অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠা ছেলে—মেয়েদের এই সাফল্য, ওদের যত না ভাল করছে তার থেকে অনেক বেশি অন্ধকার সৃষ্টি করছে। আর আমরা দেখেও হয়তো তা দেখছি না।
আমার কথাগুলো তুচ্ছ মনে হতে পারে। ভাবতে পারেন, বেশি নম্বর পাওয়া বাচ্চাদের কথা না বলে এই লেখায় কেন কম নম্বর পেয়ে মুহ্যমান বাচ্চাগুলোর গুণগান গাইছি! সেই বাচ্চাগুলো যারা কিনা একটা বাঁধা সময়ের পরীক্ষায় বসে প্রশ্নপত্রের উত্তর ঠিক করে লিখে আসতে পারেনি! কিন্তু এমন অকাট্য যুক্তি রয়েছে যা প্রমাণ করতে পারে, কম নম্বর পাওয়া বাচ্চাগুলো বেশি নম্বর পাওয়া বাচ্চাদের থেকেও এগিয়ে রাখতে পারে। তবে তার জন্য আমাদের দেশের পরিসরে আটকে থাকলে চলবে না, নজর রাখতে হবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাজনীতি, কলা, সিনেমা জগতে। পরিসংখ্যান বলছে, এই প্রতিটি ক্ষেত্রে তথাকথিত কম নম্বর পাওয়া বাচ্চাগুলোর সাফল্যের হার, বেশি নম্বর পাওয়া ছেলেদের থেকে অনেকটা বেশি।
এক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে নোবেলজয়ী মানুষদের তালিকা জীবন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই তালিকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সমস্যাটা আসলে স্কুলের পরীক্ষা পদ্ধতিতে। আর সেই জন্যই বাচ্চারা ফেল করে শুধু স্কুলের পরীক্ষায়। কিন্তু, জীবনের পরীক্ষা অন্য বিষয়। সেখানে পাশ বা ফেল এত সহজে বিচার্য নয়। গতে বাধা পরীক্ষায় বসে যে বাচ্চারা গতানুগতিকতার হিসাবে বেশি নম্বর পায় না, এ সমাজ তাদের নামের পাশে 'দুর্বল', 'কমজোরি' শব্দগুলো বসিয়ে দেয়। যেসব ছাত্ররা প্রচুর নম্বর নিয়ে পাশ করেছে, এই ব্লগ তাদের জন্য নয়। তাদের বুকে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য তো আস্ত একটা সমাজ দু’হাত বাড়িয়ে রয়েছে। বরং এটা তাদের জন্য, যাদের মাথা এই মুহূর্তে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। যারা নিজেদের পরাজিত, বিপর্যস্ত বলে মনে করতে শুরু করেছে।
আমার সহকর্মী, সাংবাদিক পীযূশ ববেলে খুব উপযোগী কয়েকটা কথা লিখেছেন। তিনি বলছেন, সিবিএসইর ফল প্রকাশ হয়েছে। অনেক বাচ্চা দারুণ ফল করেছে। কিন্তু অনেক বাচ্চা যতটা নম্বর পাওয়ার আশা করেছিল, ততটা পায়নি। নম্বর যাদের কম এসেছে আমাদের যাবতীয় আশা কিন্তু তাদের থেকেই। কারণ, গত ৭০ বছরে তথাকথিত টপার্সরা দেশের জন্য কী করেছে, তা কারও জানা নেই। তবে টপার্সরা যে নিজেদের জন্য অনেক কিছু করেছেন, সেটা হলফ করে বলা যায়। তাই বলছি, যাদের নম্বর কম এসেছে দেশ ও দশের সব আশা তাদের থেকেই।
এই কথাগুলোকে নিতান্ত কেতাবি বলে মনে করবেন না। অথবা এ গুলোকে শুধু কথার কথা বলেও ভাববেন না। জীবনের দৌড় খুব ক্রুড়, নিষ্ঠুর। প্রাণঘাতী এই প্রতিযোগিতায় নেমে আমার সন্তান কীভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে, এটাই আমাদের আরও গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আমরা সন্তানকে ইঁদুর দৌড়ে নামিয়ে দিই। আসলে, দশম বা দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা কিচ্ছু না। এগুলো আমাদের পচা—গলা ব্যবস্থার একটা বিরাট খামতি। প্রতি বছর এই পরীক্ষাগুলো প্রমাণ করে, বাচ্চাদের প্রতিভাকে তুলে ধরতে আমাদের কাছে কোনও ভালো বিকল্প পথ নেই।
আর ঠিক এই কারণেই সরকার, সমাজ ও স্কুলগুলো নিজেদের এই বহুপুরনো, রদ্দি চিন্তাভাবনাকে বদলাতে পারছে না। কিন্তু, আমরা সেইসব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নজর দিচ্ছি না, যেখানে এখনও সাত বছর বয়সের আগে স্কুলে পাঠানোর নিয়ম নেই। আমেরিকার সেইসব কলেজগুলো সম্পর্কে আমরা জানতে চাই না, যেখানে ছাত্র—ছাত্রীদের কোন বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে সেটা জানতে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করা হয়। কোনও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে সময় অপচয় না করিয়ে নিজেকে বোঝার কাজটাই এখানে সবার আগে জায়গা পায়।
কথায় কথায় এখনও এদেশে ইংরেজদের গাল পাড়া চলে। ওরাই না কি আমাদের কেরানি বানিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওরা তো দেশে ফিরেছে কয়েক যুগ হল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এল আর গেল। কিন্তু স্কুলগুলো কি পাল্টাল? শিক্ষার গাড়িটা তো সেই ইংরেজদের বিছিয়ে দেওয়া রেল লাইন ধরেই দৌড়চ্ছে এখনও। আমরা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর রাস্তা ধরে হাঁটতে চাইনি। শিক্ষার ব্যাপারে গান্ধী, বুদ্ধ, আইনস্টাইনের কথা আমাদের কান অবধি পৌঁছল না। বরং আমরা বাচ্চাদের একটা ছাঁচে ফেলে গড়ার কাজে লেগে পড়লাম।
গামলায় গাছ পুঁতে পরিবেশ রক্ষা করা যায় না। প্রকৃতিকে বাঁচাতে জঙ্গল ছাড়া উপায় নেই। ঠিক তেমনই বিশ্ব মানচিত্রে একটা দেশকে উজ্জ্বল করার কাজটা বড়দের দিয়ে হবে না, দেশের ভবিষ্যত গড়তে হলে সচেতনতার বীজ বাচ্চাদের মধ্যেই বপন করতে হবে। তাই বাচ্চাদের মার্কশিটের দাড়িপাল্লায় রেখে মাপজোক করা বন্ধ করতে হবে।
ছকে বাঁধা পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া যে বাচ্চারা আজ আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার কথা ভাবছে, তাদের হাতটা চেপে ধরুন। ওদের বোঝাতে হবে, স্কুল থেকে যে রাস্তাটা বেরিয়েছে সেটা দূরের গন্তব্য পর্যন্ত সব সময় পৌঁছায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে বা প্রয়োজন পড়লে অন্যদেরও মনে করিয় দিতে হবে, বাচ্চারা ব্যর্থ হয় না। ব্যর্থ হয় স্কুল তথা এই শিক্ষা ব্যবস্থা। বাচ্চারা সব সময় ওদের গন্তব্যে পৌঁছয়। আমরা যেন ওদের শুধু বলে দিতে পারি যে কোথায় যেতে হবে! আর এটা কিন্তু আমাদেরই কাজ। বাচ্চাদের নয়।
লেখক- জি নিউজের ডিজিটাল এডিটর।
(https://twitter.com/dayashankarmi)
(আপনাদের প্রশ্ন ও মন্তব্য ইনবক্সে পাঠান- https://www.facebook.com/dayashankar.mishra.54)
অনুবাদ- সুমন মজুমদার, জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল।