ওই পাঁচটা গর্বের রিং আসলে 'শাক', যা দিয়ে ১০০ বছর মেয়েদের মানে 'মাছ' ঢেকে রাখা হয়েছে!
স্বরূপ দত্ত
গত কয়েকদিন ধরে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের উপরে হয়েছে অ্যাসিড হামলা। মেয়েদের উপর অত্যাচার তো আর শুধু অ্যাসিড ছোঁড়াই নয়। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, খুন আর এসব কিছু করতে না পারলে, যে করেই হোক দাবিয়ে রাখো। মেয়েদের উঠতে দিলেই সর্বনাশ। পুরুষের, নারীর আশ্রয় ছাড়া চলেনি কোনওদিনই। অথচ, সেই পুরুষই যখনই পেরেছে, তখনই দাবিয়ে রেখেছে নারীকে। রিও অলিম্পিক শুরু হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকদিন হল। ভারত এই অলিম্পিকে এখনও পর্যন্ত যতটুকু মাতামাতি করেছে, তা সবই এক নারীকে নিয়ে। দীপা কর্মকার। জিমন্যাস্ট দীপা আগামী রবিবার পদক না জিততে পারলেও আমাদের অহংকার হয়ে অলঙ্কারের মতো গলায় ঝুলবেন।
প্রশ্নটা বা দ্বিধাটা এখানেই আসছে মনে। বড় দ্বিচারিত মনে হচ্ছে যেন। অলিম্পিক। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ। গোটা পৃথিবীর সবথেকে বড় বিনোদনের আসর। অলিম্পিকের ভালো নিয়ে কথা বললে, সে কথা শুরু তো হবে। কিন্তু শেষ হবে না। এতটাই কৃতিত্ব দাবি করতে পারে অলিম্পিক। কিন্তু মেয়েদের প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস কী আর অলিম্পিকে কম? সব যেন লুকিয়ে রাখার বা শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার মতো করে চেষ্টা করে যাওয়া। আজ সেই শাকগুলো উপর থেকে তুলে দেওয়ার একটা চেষ্টা করছি মাত্র। দেখাতে চাইছি, ওই পাঁচটা গর্বের রিঙের মাঝে বছরের পর বছর ধরে মেয়েদের কতটা বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। যেগুলো পড়তে পড়তে, কখনও শিউরে উঠবেন, কখনও অবাক হবেন আর আপনি পুরুষ হলে কখনও হীনমন্যতায়ও ভূগবেন।
১) আধুনিক অলিম্পিক শুরু হয়েছিল ১৮৯৬ সালে এথেন্সে। ওই অলিম্পিকের মূল সংগঠক ছিলেন ফরাসি কুবের্তিন। মূলত তাঁর এবং তাঁর সহকারীদের বদান্যতায় সেই প্রথম আধুনিক অলিম্পিকের মঞ্চে নামাই হয়নি এই পৃথিবীর কোনও নারীর! কারণ, আজ কুবের্তিনরা যতই পুজো পান, সেই আমলে তাঁদেরও নারীদের অলিম্পিকের মঞ্চে সুযোগ দিতে আঁতে লেগেছিল!
২) চার বছর পর ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকে অবশ্য মেয়েদের জায়গা হল। তবে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ওই দয়া পাওয়ার মতো করে শুধুমাত্র লন টেনিস আর গলফেই নামতে দেওয়া হল মেয়েদের! বাকি খেলাগুলোতে যে আরও খাটো পোশাক পরতে হবে। পুরুষ হাফ প্যান্টে ১৯০০ সালেও থাকবে। অথচ, ২০১৬ সালে এসেও নারী শরীরে হট প্যান্ট চলবে না! 'অসভ্য'। জানি জানি না, শব্দটা কাদের জন্য বেশি প্রযোজ্য!
৩) অলিম্পিকের সাঁতারের পুলে মেয়েদের নামতে নামতে লেগে গিয়েছিল আরও কয়েক বছর। ১৯১২-র অলিম্পিকে জলপরীরা প্রথম সাঁতার কাটলো। কিন্তু আমেরিকা পাঠায়নি কোনও প্রতিযোগী! আজ আমেরিকা এত আধুনিক অথচ, এরাই ১৯১২-তে নিজেদের দেশের সেরা সাঁতারু মেয়েদের জলে নামতে দেয়নি শুধু লম্বা স্কার্টের দোহাই দিয়ে! মেয়েদের ভেজা শরীরে আমেরিকানদের এত লজ্জা পাওয়া দেখে আদিখ্যেতা ছাড়া আর কীই বা বলি!
৪) ১৯২৮ সালে মেয়েরা প্রথমবার নামল অলিম্পিকের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে। কিন্তু তাতেও ৮০০ মিটার দৌড়ে হল বিতর্ক। অবস্থা পৌঁছলো এমন জায়গায় যে, ১৯৬০ পর্যন্ত ওই ইভেন্ট বন্ধই থাকলো! মেয়েদের আটকানোর সেরা রাস্তা তো এটাই। দাও সব কিছু বন্ধ করে!
৫) অলিম্পিকে মেয়েরা শুটিং ইভেন্টে নামতে পারল ১৯৮৪ সালে এসে! হাসবেন না তো কী! পুরুষ বন্দুক, কামান, পরমাণু বোমাও ফেলে দিতে পারে অবলীলায়! অথচ, নারীকে খেলার মঞ্চে বন্দুক হাতে পেতে লেগে গেল এতগুলো বছর! নারীর যে অস্ত্র ধরার অধিকারই নেই। হলই বা বিশ্বের সেরা খেলার মঞ্চ!
৬) ১৯৯৬ সালে অবশ্য পুরুষ বড্ড উদার হয়ে গেল! উদারতার কারণ? আধুনিক অলিম্পিকেরও ১০০ বছর পেরিয়ে গেল যে। তাই 'নরম নারী'-র জন্যই যেন সফট বলকে ঢোকানো হল, অলিম্পেকর আসরে। কিন্তু উদারতা বেশি দিন টেকেনি!
৭) মজাটা এবার আরও পাবেন। সেই আদি থেকে যে নারী সব ভার মুখ বুজে সয়ে এলো, সেই নারীকে প্রথমবার অলিম্পিকে ভারোত্তলন করতে দেখা গেল ২০০০ সালের অলিম্পিকে এসে! মেয়েরাই সেদিন মুচকি হেসে বলেছিল, 'হাসাইলে মোরে বালক!'
৮) ভার তুলতে বা ওজন তুলতে তো দেওয়া হল। কিন্তু দুই নারী কুস্তি করবে অলিম্পিকের মঞ্চে এসে! সম্মান যাবে না! তাই তো ২০০৪ সালে এসে মেয়েরা কুস্তিও লড়তে পারল অলিম্পিকে এসে।
৯) কাতার, ব্রুনেই এবং সৌদি আরব তো ছিল আরও এক কাঠি উপরে। তারা কোনও খেলাতেই অলিম্পিকে মেয়েদের নামতে দেয়নি কোনওদিন। কিন্তু ২০১২-সালের লন্ডন অলিম্পিকে এসে আইওএ-র সামনে মাথা নত করতে হয় এই তিন দেশকেও। তারাও গত অলিম্পিকে নিজেদের দেশের সেরা মহিলা ক্রীড়াবিদদের খেলার সুযোগ দিলেন প্রথমবার। ঠ্যালায় পড়ে! তাই কোনও কৃতিত্ব ওরা দাবি করতেও পারেন না। আর কেউ সেটা দিচ্ছেও না।
১০) চলতি রিও অলিম্পিকে যত পদক প্রতিযোগীরা জিতবেন, তাঁর ৪৪ শতাংশই পাবেন মেয়েরাই! যাঁদের গত ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাবিয়ে রাখা হল, তাঁরা কিন্তু এখনই ৪৪ শতাংশ পদকের মালিক! তাহলে আগামিদিন অবস্থাটা কোথায় যেতে পারে আন্দাজ করুন। ওই যে, নিউটনের সূত্র। যেমন একসময় দাবিয়ে রাখা হয়েছে মেয়েদের। তাঁরা তো ঠিক অতটাই শক্তি দিয়ে উপরে উঠে আসবেন!
আরও পড়ুন পশ্চিমবঙ্গের নাম পাল্টাতে চাইছেন যাঁরা, তাঁদের ছোট্ট একটাই প্রশ্ন