তুঘলকি রাজের বিধান: একে 47 বনাম বেতের ঢাল

'সব বেটাকে ছেড়ে দিযে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর' হাঁক ছেড়ে উদারপন্থী বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতি প্রয়োগ করার একমাত্র ল্যাবরেটরি হিসাবে সরকারি পরিবহনকে বেছে নিযেছে রাজ্য সরকার। পাঁচটি সরকারি পরিবহন সংস্থাকে বলা হয়েছে তাদের নিজেদের খরচের টাকা রোজগার করতে হবে।

Updated By: Nov 18, 2011, 12:06 AM IST

'সব বেটাকে ছেড়ে দিযে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর' হাঁক ছেড়ে উদারপন্থী বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতি প্রয়োগ করার একমাত্র ল্যাবরেটরি হিসাবে সরকারি পরিবহনকে বেছে নিযেছে রাজ্য সরকার। পাঁচটি সরকারি পরিবহন সংস্থাকে বলা হয়েছে তাদের নিজেদের খরচের টাকা রোজগার করতে হবে। সরকার ভর্তুকি দেবে না। ফলে এই কোম্পানিগুলির প্রায 18 হাজার কর্মী অক্টোবর মাস থেকে বেতন পাচ্ছেন না। পেনশন পাচ্ছেন না অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরাও।

সাধারণভাবে যে কোনও বাণিজ্যিক সংস্থার নিজের আয়েই চলার কথা। যে কোনও ব্যবসায়ও ভর্তুকি মোটেই ভাল কিছু নয়, চিরকাল চলতেও পারে না। ভর্তুকিতেই সরকারের টাকা বেরিযে গেলে প্রাথমিক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, দরিদ্রতম মানুষের ন্যূনতম কাজের সংস্থান ইত্যাদিতে টাকা আসবে কোথা থেকে?

তবু পরিবহন ক্ষেত্রে তুঘলকি রাজ চলছে বলতে বাধ্য হচ্ছি কযেকটা কারণে

প্রথমত, সরকারের দিক থেকে ভর্তুকি বন্ধ করার একটা যুক্তি হল যে প্রায 18 হাজার কর্মীর মধ্যে প্রায সাড়ে তিন হাজারের নিয়োগ সন্দেহজনক। বামফ্রন্টের আমলে দলীয় আনুগত্যের কারণে বেআইনিভাবে এঁদের চাকরি দেওযা হযেছিল। অভিযোগটা সত্যি হতেই পারে। পরিবহন নিগমগুলিতে সরকারি দাক্ষিণ্যে অপ্রয়োজনীয় চাকরি দেওয়ার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। কিন্তু তার জন্য বাকি সাড়ে 14 হাজার বৈধ কর্মীর বেতন বন্ধ হয কী করে? এটাই তুঘলকি রাজ।

দ্বিতীয়ত, যে কোনও বাণিজ্যিক সংস্থায় ব্যবসার ধরন পাল্টানো একটা পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। তার জন্য ম্যানেজমেন্টের ভাবনার পরিবর্তন, টাকার ব্যবস্থা, কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্নিয়োগ দরকার। এ সবের জন্যই সময় দরকার। বহু বছর একভাবে চলে আসা একটি কোম্পানিকে বলে দেওয়া হল, 'কাল থেকে বাপু তোমাকে লাভ করতে হবে'। এটাই তুঘলকি রাজ।

তৃতীয়ত, নানা ধরনের কর বসাতে রাজ্য সরকার রাজি নয় বলে দেশ জুড়ে নগরোন্নযনের সবচেযে বেশি অর্থকরী প্রকল্পের (জে এন এন ইউ আর এম) টাকা পাচ্ছে না। বিদ্যুতের দাম বাড়াতে রাজি না হওয়ার ফলে রাজ্যের বিদ্যুত্ সংস্থাগুলি চরম সঙ্কটে পড়েছে। বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ নিযে বিস্তর প্রচার সত্ত্বেও রাজ্যের পশ্চাদমুখী অর্থনৈতিক ভাবনার ফলে বাস্তবে রাজ্য সরকার গত ছয় মাসে কেন্দ্রের থেকে বাড়তি কিছু পায়নি। উদারপন্থী বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতি প্রয়োগ করার অনেক জরুরি এবং ফলপ্রসূ জায়গা ছেড়ে শুধু পরিবহন ক্ষেত্রে সংস্কার হচ্ছে। এটাই তুঘলকি রাজ।

চতুর্থত, সরকারি পরিবহনকে বেতের ঢাল নিয়ে একে 47-এর মোকাবিলা করতে বলছে রাজ্য সরকার। এদের ভাড়া অথবা রুট ঠিক করার স্বাধীনতা নেই, চাহিদা মতো জোগান বাড়ানো কমানোর ক্ষমতা নেই, কর্মী ছাঁটাইয়ের ক্ষমতা নেই। বাজার থেকে টাকা তোলার ক্ষমতা নেই এবং তার জন্য জবাবদিহির দায় নেই। তা সত্ত্বেও বাজার অর্থনীতির নিযম মেনে এদের লাভ করতে বলা হচ্ছে। এটাই তুঘলকি রাজ।

পঞ্চমত, রাজ্যের অন্য গণ পরিষেবামূলক উদ্যোগের (public utility) ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হল নেহরুর আমলের সমাজবাদী জনকল্যাণকর ভাবনা অনুসারী। দুধের নাম বাড়বে না (যার জন্য মাদার ডেযারিকে 'গরুর দুধ' তুলে দিয়ে অনেকটা দাম বাড়িয়ে নতুন নামে একই জিনিস বাজারে ছাড়তে হয়েছে)। বিদ্যুতের দাম বা গণ পরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হবে না। এই সব বিষয়গুলিকে সাধারণ মানুষের প্রাপ্য এবং সরকারের দেয় বলে ধরা হচ্ছে। অথচ যে গণ পরিবহনকে পশ্চিমী দেশেও প্রায়শই সরকারি কর্তব্য এবং তাই ভর্তুকির যোগ্য দাবিদার বলে গণ্য করা হয, তাকে রাজ্য সরকার বলছে বাজার অর্থনীতি মেনে চলতে। এটাই তুঘলকি রাজ।

মহম্মদ বিন তুঘলক তাঁর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ভুল বুঝতে পেরে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। রাজ্য সরকার এখনও করেনি।

সুদীপ্ত সেনগুপ্ত

Tags:
.