Uttam Kumar Birth Anniversary: বাংলা ছবির 'জুলিয়াস সিজার', উত্তমের ম্যাজিকে আজও মজে বাঙালি!
কেরিয়ারের প্রথম ৭টি ছবি পর পর ফ্লপ হওয়ায় ইন্ডাস্ট্রি 'ফ্লপ মাস্টার জেনারেল' উপহার দিয়েছিল তাঁকে
সৌমিত্র সেন
বিস্মৃতিপ্রবণ বাঙালি তাঁকে আজও মনে রেখেছে, এটাই বোধ হয় সব চেয়ে আশ্চর্যের। আবার, হয়তো এটা তত আশ্চর্যেরও নয়, যদি ক্রমে আমরা জানতে পারি, তিনি, গুটিকয় অতিবিরল প্রতিভার মতোই বাঙালিকে একরকম বাধ্য করেছেন তাঁকে মনে রাখতে। তাই, আজও ৩ সেপ্টেম্বর এলে বাঙালির মনকেমনিয়া জাগে। টালিগঞ্জ আর আহিরীটোলায় তাঁর মূর্তিতে শুধু মাল্যদান করেই ক্ষান্তি দেয় না স্বভাবতই অলস ও আয়েশি এই জাত; বরং এদিন সে আরও নানা আয়োজনে মগ্ন হয়, অকৃত্রিমতার সঙ্গেই তাঁর অভাব অনুভব করে। তিনি মহানায়ক উত্তমকুমার।
কেন এবং কী ভাবে এটা ঘটল, সে এক বিচিত্র ডিসকোর্স হতে পারে। সে বিপুল আলোচনা ক্ষেত্রবিশেষে বাহুল্যই হয়তো। কিন্তু এটুকু অন্তত মনে করা যেতেই পারে যে, প্রথম থেকেই তো উত্তম 'উত্তম' ছিলেন না। 'অরুণ'কান্তি 'ফ্লপ মাস্টার জেনারেল' (কেরিয়ারের প্রথম ৭টি ছবি পর পর ফ্লপ হওয়ায় ইন্ডাস্ট্রি এই উপাধি উপহার দিয়েছিল তাঁকে) থেকে ক্রমে 'উত্তম' হয়ে 'নায়ক' এবং তারও পরে 'মহানায়ক'-এর তাঁর যে যাত্রা, তা এক পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থা, যেখানে বিচিত্র কাঁটা ও ক্ষত, আঘাত ও রক্ত সদা ওত পেতে থাকত। তবে বিক্ষত হতে-হতেও তিনি শেষ পর্যন্ত জিতে যান শুধু এক বিচিত্রবর্গের প্রতিভার জেরে। মনে রাখার মতো অভিনয়-প্রতিভা তো তাঁর সময়ে কমজনের ছিল না! তবু আজ, এই ভয়ানক ছিমছাম অভিনয়ের যুগেও কেন বাঙালি তাঁকে এত করে 'মিস' করে, তা এক আশ্চর্য বইকি!
আরও পড়ুন: Uttam Kumar: সারাজীবনে অজস্র হিটের পরেও কেন্দ্রবিন্দুতে 'নায়ক', ৫৫ বছর ধরে সেই ট্র্যাডিশন চলছেই
প্রথম দিকে সংলাপ ভাল বলতে পারতেন না (কিঞ্চিত্ স্ট্যামারিং ছিল, যা পরে অনেক কষ্টে শুধরে নেন); প্রথম দিকে দেহসৌন্দর্যও দারুণ চোখে-পড়ার মতো কিছু ছিল না; সাফল্য মেলার পরেও অধিকাংশ ছবিতেই 'টাইপ কাস্ট'; ইন্ডাস্ট্রির টেকনিক্যাল মানের অনুন্নতির কারণে অতি সাধারণ মানের মেক-আপ (চোখে কাজল, ঠোঁট মোটা করে আঁকা, মুখে চড়া পমেটম ইত্যাদি...ইত্যাদি) যা আজকের প্রজন্মের কাছে মোটেই দাম পায় না-- এবং এরকম আরও আরও কত কত কালিক প্রতিবন্ধকতার শিকার যে তিনি, তার ইয়ত্তা নেই! অথচ আজও তিনি 'মহানায়ক'!
আসলে প্রতিভার সঙ্গে শ্রম আর সঙ্কল্প তাঁকে এই অনন্য উচ্চতায় তুলে আনে। ১৯৫৫-পূর্ব উত্তমের সঙ্গে পরবর্তী উত্তমকে প্রায় মেলানোই যায় না! আবার ১৯৬০-উত্তর উত্তম যেন আর-এক বিস্ময়। ১৯৬৫-পর্ব পরবর্তী সময়ে উত্তম যেন প্রায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই! ততদিনে তো নন্দিত দেহসৌষ্ঠব, অনাবিল হাসি, অকৃত্রিম চাহনি-র বহির্অলঙ্কারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে গভীর রোম্যান্টিক কণ্ঠস্বরে অপূর্ব ডায়ালগ-থ্রোয়িং, অতি বাঙ্ময় ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন এবং চরিত্র ও পরিপার্শ্ব মিলিয়ে সহজ কিন্তু নিটোল অভিব্যক্তি। তখন সাধারণ মানের গল্প, সাধারণ চিত্রনাট্য, সাধারণ কো-অ্যাক্টরদের নিয়েও তিনি তাই বাংলাছবির জুলিয়াস সিজার, যিনি রোজ রুবিকন পেরোন আর নতুন করে ইতিহাস সৃষ্টি হয়।
মোটামুটি ভাবে ১৯৭০-এর পর থেকেই 'নায়ক' উত্তম হয়ে গেলেন 'মহানায়ক'। যে ইন্ডাস্ট্রি একদিন বিদ্রুপ করে 'এফএমজি' ডেকেছিল তাঁকে, সেই ইন্ডাস্ট্রির কাছেই প্রায় পূর্বাপরহীন এক অবতার হয়ে দেখা দিলেন উত্তম। তখন ১৯৪৮-১৯৫২ সালপর্বের ওই চরম অসফল পর্যায় আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস। আর সেই রক্তাক্ত পরাজিত ইতিহাসের উপরেই তিনি স্বসাধিত শিল্পীসত্তার এক অপরাজেয় উত্তুঙ্গ সৌধ রচনা করলেন। যেখানে একটু বেশি আগের যুগের ছবি বিশ্বাস পাহাড়ী সান্যাল, প্রায় কাছাকাছি সময়ের বিকাশ রায় অসিতবরণ, সমসাময়িক অনিল-বসন্ত এবং পরের যুগের বিশ্বজিত্-সৌমিত্র-শুভেন্দুর কীর্তিও একটু যেন ম্লান প্রতিভাত হয়। উত্তমের মধ্যে এমন কী যেন একটা আছে, যা ঠিক অন্যদের মধ্যে (তা তিনি যত বড় মাপের শিল্পীই হন না কেন) নেই! কী আছে-- এই খুঁজতেই খুঁজতেই বাঙালি বুড়ো হয়ে গেল। ফলে উত্তমকে আর ভোলাই হল না!
এই 'অ-কারণ' উত্তম-মুগ্ধতার জন্য সাধারণ বাঙালি দর্শককে দোষ দিয়ে লাভও নেই। কেননা, শোনা যায়, এই উত্তম-আবেশে মুগ্ধ হয়েছিলেন হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী স্বয়ং এলিজাবেথ টেলরও! 'নায়ক' দেখার পর তিনি নাকি রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন, উত্তমের সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছিলেন! কী ছিল উত্তমে? কী আর, অতি উত্তম এক ম্যাজিক ছাড়া?
অধম ও মধ্যম-কে অতি সাবধানে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি পর্দায় তাঁর চলাফেরায়, হাসি-কান্নায়, বাচনে-গায়নে, প্রেমে-ক্রোধে, ক্রূরতা-উদাসীনতায় এমন এক মরমি মায়া বুনে যেতেন যে তার তল মাপা যেত না: এবং আজও যার ব্যাখ্যা হয় না, বিশ্লেষণ হয় না। যা দিনান্তে বরং এক 'ম্যাজিক-রিয়ালিজমে' পর্যবসিত হয় এবং দর্শক অন্ধকার পর্দার দিকে বুঁদ হয়ে তাকিয়ে বসে থাকে!