Omkar Panchami: ধ্যানের মধ্যে দিয়ে তিনি শুনতে পেতেন ওঙ্কারধ্বনি! পরবর্তীকালে নামে ডুবিয়ে দিলেন দেশ-কাল
পুরীতে তাঁর জগন্নাথের বিশেষ দর্শন ঘটেছিল।
সৌমিত্র সেন
তিনি নাম-মন্ত্রে অনুনাদিত করেছিলেন জনচিত্ত; তিনি নাম-রসে পরিপ্লাবিত করেছিলেন গণমন; তিনি প্রেমে ও ত্যাগে অভিষিক্ত করেছিলেন সাধারণকে; তিনি তিতিক্ষা ও কৃচ্ছ্রতার দীক্ষায় দীপ্ত করেছিলেন লোকসাধারণকে। তিনি শ্রীশ্রী সীতারামদাস ওঁঙ্কারনাথ ঠাকুর। আগামি কাল তাঁর জন্মদিন। দিনটি ভক্তপরিসরে 'ওঁকার পঞ্চমী' বলেই খ্যাত।
১৮৯২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি (১২৯৮ বঙ্গাব্দের ৬ ফাল্গুন, কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথি) হুগলির কেওটা গ্রামে শ্রী শ্রী সীতারামদাসের জন্ম। তাঁর পূর্বনাম অবশ্য ছিল প্রবোধচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। হুগলিরই ডুমরদহ ছিল প্রবোধের নিজের গ্রাম। তাঁদের কুলদেবতা ছিলেন ব্রজনাথ। যথারীতি গ্রাম্য পাঠশালায় প্রবোধের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও তাঁর মন অতি প্রথমলগ্ন থেকেই ছিল ঈশ্বরপ্রেমে মগ্ন, ঈশ্বরানুভূতিতে মুগ্ধ। ধ্যান ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। কথিত আছে, এই ধ্যানের ফলেই তাঁর নানা রকম দর্শনও ঘটেছিল। ধ্যানেই তিনি শুনতে পেতেন ওঙ্কারধ্বনি। তিনি দাশরথিদেব যোগেশ্বরকে গুরুরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। তিনিই প্রবোধের নাম দিয়েছিলেন 'সীতারাম'; আর পরে স্বামী ধ্রুবানন্দ গিরি তাঁকে 'ওঙ্কারনাথ' উপাধি দেন। এর পর থেকে প্রবোধচন্দ্র খ্যাত হলেন সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ হিসেবে। এরপর সারা জীবন ধরে তিনি 'হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে' মন্ত্র তথা নামই প্রচার করে গেলেন। এই নামের রসে প্লাবিত করলেন তিনি তাঁর দেশ-কাল-সময়কে।
তবে প্রথমদিকে নাম প্রচার করলেও সীতারামদাস কাউকে আক্ষরিক অর্থে মন্ত্রদীক্ষা দিতেন না। কিন্তু শোনা যায়, পুরীতে তাঁর জগন্নাথের বিশেষ দর্শন ঘটেছিল। তিনি নাকি সাধারণকে মন্ত্রদীক্ষা দিতে জগন্নাথ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিলেন! তার পরই তিনি দীক্ষাদান শুরু করেন। এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে তিনি দীক্ষা দেন।
এ বছরটি সীতারামদাস ঠাকুরের ১৩০তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ৭৫টিরও বেশি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি অখিল ভারতীয় জয়গুরু সম্প্রদায়ের প্রধান। কলকাতার ডানলপের কাছে প্রতিষ্ঠিত মহামিলন মঠই সীতারামদাস-প্রতিষ্ঠিত মঠসকলের প্রধান। ওঙ্কারপঞ্চমীর দিনটিতে সাধারণত মহামিলন মঠে দিনভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। সারাদিন ধরে থাকে নামগান, ধর্মসভা, প্রসাদ বিতরণ ইত্যাদি আরও নানা কিছু।
দেশে যখন অধর্মের শাসন শুরু হয়, জনসাধারণের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য তখন লোকশিক্ষকগণের আবির্ভাব ঘটে, এ তো চিরকালেরই আধ্যাত্মিক নিয়ম। ধর্ম-আলোচকেরা বলেন, সেরকমই সময় ছিল উনিশ শতকের শেষার্ধ। আর সেই সময়েই আবির্ভাব হয় সীতারামদাসের। পিতা প্রাণহরি চট্টোপাধ্যায়, মাতা মালাবতী দেবী। কালক্রমে স্মৃতিভূষণ দাশরথি মুখোপাধ্যায়ের চতুষ্পাঠীতে শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় পান্ডিত্য অর্জন করলেন প্রবোধচন্দ্র। কিন্তু সর্বক্ষণ রামনাম জপে মগ্ন প্রবোধচন্দ্র রামনাম জপতে জপতে ডুবে যেতেন ভাবসাগরে। আত্মীয়স্বজনরা প্রবোধচন্দ্রের অবস্থা দেখে দিগসুই গ্রামের ঠাকুরচরণ ভট্টাচার্য্যের কন্যা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিলেন। কিন্তু তিনি ডুব দিলেন ভক্তিসাগরে। ফলে তাঁর সংসারে টানও ছিল না। স্ত্রীকে তিনি বললেন, 'সংসার আর ভগবান, একসঙ্গে দুটো হয় না। একটা ছাড়তে হবে।' এক সময়ে স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরীকে দুই পুত্র এবং এক কন্যাকে রেখে একদিন সত্যি সত্যিই সংসার থেকে চিরবিদায় নিলেন। নাম নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
লোকশ্রুতি, ধীরে ধীরে অলৌকিক শক্তির অধিকারীও হয়ে উঠেছিলেন সীতারাম। সারা ভারত পরিক্রমা করে ১৯৩৬ সালে সীতারাম ফিরেছিলেন তাঁর দীক্ষালাভস্থান ত্রিবেণীতে। সেখানে স্থাপন করেছিলেন মঙ্গলঘট। তারপর একটি বটপাতায় 'ওঙ্কারনাথ' লিখে বহির্বাস ত্যাগ করে কৌপীন ধারণ করে ডুমুরদহে তাঁর জন্মভিটেতে ফিরেছিলেন। ১৯৮২ সালের ৫ ডিসেম্বর, রবিবার, গভীর রাত্রে ৯১ বছর বয়সে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ চলে গেলেন আনন্দধামে। কিন্তু রয়ে গেল তাঁর অমর্ত্য আত্মা, তাঁর নাম-গান, তাঁর আধ্যাত্মিক উদযাপন।
আরও পড়ুন: Mirza Ghalib: মৃত্যুর বাসনা নিয়ে বেঁচে থাকাই লেখা এ কবির ভাগ্যে!