Exclusive Pt Swapan Chaudhuri: তালটাকে নিয়ে নিজের মতো দেখতে-দেখতে ভাবতে-ভাবতে ওই বিশেষ রূপটা আনতে পেরেছি...
Tabla Maestro Pt Swapan Chaudhuri: জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো'কে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী। এক্সক্লুসিভ সেই সাক্ষাৎকারে অনন্য এই শিল্পী তাঁর বেড়ে-ওঠা, স্ট্রাগল, নিজস্ব সংগীতদর্শন, হালের তবলাবাদন এবং উচ্চাঙ্গ সংগীতের নানা বিষয় নিয়ে নানা বিরল ও চিন্তাজাগানো কথাবার্তা বলেছেন। সুদীর্ঘ ও মূল্যবান এই সাক্ষাৎকার একাধিক পর্বে প্রকাশিত হবে। এটি প্রথম।
সৌমিত্র সেন
সম্প্রতি এক বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তবলাবাদক পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী! তিনি সংগীত নাটক একাডেমির 'ফেলো' নির্বাচিত হয়েছেন। এবছর সংগীত নাটক একাডেমি ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে। দেশ জুড়ে মোট ১২৮ জন শিল্পী সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু ফেলোশিপ পেয়েছেন সারা দেশে মাত্র ১০ জন। তাঁদেরই একজন তবলা মায়েস্ত্রো পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী। দিল্লিতে গিয়ে সদ্য সেই পুরস্কার গ্রহণও করেছেন তিনি। এই উপলক্ষে জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো'কে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শিল্পী। এক্সক্লুসিভ সেই সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের বেড়ে-ওঠা, নিজের স্ট্রাগল, নিজের সংগীতদর্শন, হালের তবলাবাদন এবং উচ্চাঙ্গ সংগীতের আরও নানা বিষয় নিয়ে নানা বিরল ও চিন্তাজাগানো কথাবার্তা বলেছেন। সুদীর্ঘ এই সাক্ষাৎকার একাধিক পর্বে প্রকাশিত হবে। এটি প্রথম পর্ব।
প্র. সংগীত নাটক একাডেমির ফেলোশিপ পেয়ে কেমন লাগছে? বিষয়টা নিয়ে কি আপনি খুব উচ্ছ্বসিত, না কি একেবারেই তা নন বরং নিস্পৃহ, না কি শুধু মনে হচ্ছে-- ঠিক আছে?
উ. মনে হচ্ছে, ঠিক আছে। আমার মতে, আমরা যাঁরা গানবাজনা করি, শিল্পী, তাঁরা সরকার আমাদের কী দিল বা আমরা কোথায় কী পুরস্কার-সম্মান পেলাম তার চেয়েও বড় কথা, দর্শক বা শ্রোতাদের থেকে আমরা কতটা ভালোবাসা পেলাম।
প্র. একটা সময়ে ক্রিকেটে যেমন 'ফ্যাব ফাইভ' কথাটা চালু ছিল, তেমনই ইদানীং তবলাজগতে 'ফ্যাব ট্রায়ো' কথাটা খুব চালু। সেই ট্রায়োতে রয়েছেন জাকির হুসেন, কুমার বোস এবং আপনি। এ নিয়ে আপনি কী বলবেন?
উ. আমার মনে হয়, এভাবে বলাটা ঠিক নয়। কারণ আরও অনেকে আছেন যাঁরা উচ্চমানের তবলা বাজান। তাহলে এঁদের ছোট করা হয়। সেটা ঠিক নয়। আমার মনে হয়, সকলকেই ভালো বলা উচিত। যে যাঁর মতো করে সাবজেক্টটা দেখছেন, তিনি তাঁর মতো করে সেটা বাজাচ্ছেন। লেখকদের ক্ষেত্রেও যেমন তাঁরা নিজেদের স্টাইল নিয়ে এগিয়ে যান। প্রত্য়েকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা।
আরও পড়ুন: Tabla Maestro Pt Swapan Chaudhuri: বিরল সম্মানে ভূষিত তবলাবাদক পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী!
প্র. ঠিক আছে, তবু বলি, আপনারা যখন মঞ্চে বাজাতে আসছেন তখন কিন্তু শ্রোতাদের একটা অন্যরকম 'ফিল' হয়। তাঁরা মনে করেন, আপনাদের বাজনা থেকে আলাদা কিছু পাবেন তাঁরা। আপনারা যেন আপনাদের শিল্প দিয়ে মেসমেরাইজ করে দেন। এটা তো সত্যিই হয়। আর সেটাই তো অন্যদের চেয়ে আপনাদের অনেকটা আলাদা করে দেয়। দেয় না?
উ. আমরা যাঁরা গান-বাজনা করি, তাঁরা আমাদের নিজেদের গান-বাজনাকে একটা আলাদা রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি ঠিকই। ওটাই নিজস্বতা। অনুকরণ নয়। আজও উত্তমকুমার বা দিলীপকুমারের ছবি দেখে মানুষ আনন্দিত হন। ওই কারণেই হন। এঁরা এঁদের শিল্পকে একটা আলাদা রূপ দিতে পেরেছিলেন। গান-বাজনার ক্ষেত্রেও এটা হয়। যেমন, কোনো শ্রোতা হয়তো বিলায়েৎ খাঁর সেতার শুনতে যাবেন। তা, তিনি ভাবছেন, আজ বিলায়েৎ খাঁর সেতার শুনতে যাব, আজ নিশ্চয় আলাদা কিছু শুনব। আবার কেউ হয়তো একদিন আলি আকবর খাঁ সাহেবের সরোদ শুনতে যাবেন, তিনিও এইরকম ভাবছেন। রবিশঙ্করজির ক্ষেত্রেও এক ব্যাপার। এটা হচ্ছে, কারণ এটা এঁরা তৈরি করেছেন। কোনও শর্টকাটে যাননি। এর পিছনে অনেক খাটতে হয়। শেখা তো আছেই, সঙ্গে চিন্তাভাবনা। গুরুর কাছে যেটা শিখেছি, সেটা নিয়ে নিজের মতো করে চিন্তাভাবনা করতে হয়। করতে করতে গান-বাজনাটা নিজের মতো একটা রূপ পেয়ে যায়। পরে সেটাই নিজের স্টাইল হয়ে দাঁড়ায়।
প্র. তালের প্রসঙ্গে বলি। তাল তো আসলে একটা অঙ্ক। বিখ্যাত বা অখ্যাত যিনিই তিনতাল বাজান না কেন, তালের অঙ্কটা সকলের ক্ষেত্রেই তো এক। কিন্তু আপনি যখন তিনতাল বাজাচ্ছেন, তখন সেটা আলাদা হয়ে যাচ্ছে কী করে? তখন কী একটা যেন থাকছে সেই বাজনায়, আমরা ধরতে পারছি না, কিন্তু কিছু আছে। আপনি সেখানে নতুন কিছু যোগ করতে পারছেন কী করে? মানুষের কাছে তো এটা একটা রহস্য...তারা মনে করে, ওই হাতটায় কী আছে, ওই আঙুলগুলোয়...?
উ. ওই যে বললাম, চিন্তাধারা। আমি তালটাকে নিয়ে ওইভাবে চিন্তা করেছি। আমি ওই তালটাকে ওই ভাবে দেখেছি। দেখতে-দেখতে ভাবতে-ভাবতে হয়তো আমি ওই রূপটাকে আনতে পেরেছি। আবার ওই রূপটাও কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। যদি আমি কাউকে অনুকরণ করি, রূপটা তা হলে বদলায় না। একটা জায়গাতেই থেকে যায়। যখন নিজের মতো করে বাজাই তখন ওইটাই হয়ে দাঁড়ায় নিজস্বতা। ওটাই বিশেষত্ব। ওটা করতে গেলে অনেক খাটতে হয়। অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। চিন্তা-ভাবনা না করলে এগনো যায় না। গন্ডির বাইরে বেরনো যায় না। আমাকে তো গন্ডির বাইরে বেরোতে হবে। না হলে গন্ডির ওপারে কী হচ্ছে, সেটা জানতে পারব না। কিন্তু আমাকে তো সেটা জানতে হবে। যাঁরাই গানবাজনা নিয়ে ওপরে উঠেছেন তাঁরাই এই চিন্তা-ভাবনা করে খাটাখাটনি করে এগিয়েছেন। কাউকে অনুকরণ করেননি। ইনফ্লুয়েন্স থাকতে পারে, অনুসরণ থাকতে পারে, অনুকরণ নয়। আমরা এখন শর্টকাটে চলে এসেছি। কিন্তু আমি শর্টকাটে বিশ্বাস করি না। দেখুন না, হেমন্ত বা শ্যামলের গান শুনলে আজও মনে হয়, আলাদা কিছু শুনছি। যেমন কিশোর কুমার। কিশোরকে তো অনেকেই অনুকরণ করেছেন, তাঁরা সব কোথায় গেলেন!
প্র. তবলার অঙ্ক আর অর্থনীতির অঙ্ক মেলালেন কী করে ? পড়াশোনাটাও অনেকদূর পর্যন্ত করলেন এবং বাজনাও। কী ভাবে সম্ভব হল?
উ. ডিসিপ্লিন। অনেকেই বলেন, সময় পাচ্ছি না। রেওয়াজ করতে পারছি না। এটা আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না। আমার বাবা খুব নিয়মানুবর্তী ছিলেন। তিনি একটা রুটিন করে দিয়েছিলেন। সময় বেঁধে রেওয়াজ, পড়াশোনা, স্কুল, খেলাধুলো, তালিম সব চলবে। বাবা ভোর চারটের সময় ডেকে দিতেন-- ৪টে ১৫ থেকে ৬টা ১৫ দুঘণ্টা রেওয়াজ, তার পরে ব্রেকফাস্ট, স্কুলের হোমওয়ার্ক করে স্কুল; স্কুল থেকে ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, পরে আবার হোমওয়ার্ক, সন্ধে ৭টার সময়ে আমার গুরু আসতেন। গুরুর কাছে ১০টা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তালিম চলত। ননস্টপ ২০ বছর সেভেন-ডেজ-আ-উইক এই ভাবে চলেছে।
আর গুরুজি বলে দিয়েছিলেন, রেওয়াজে কোনও গাফিলতি চলবে না। বলতেন, স্টেজে কবে যাব, এই ভাবনাটা একদম বন্ধ করে দাও, ওদিকটায় পর্দা ফেলে দাও। শেখায় মন দাও। তো, আমি সেটাই করেছি।
(জেনে রাখা জরুরি, স্বপন চৌধুরীর আগে মাত্র ১৬ জন বাঙালি সংগীত নাটক একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হওয়ার বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬২ সাল থেকে এই ফেলোশিপ প্রদান শুরু। প্রথম বছর পেয়েছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীতশিল্পী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পর থেকে যেসব বাঙালি এই সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন তার তালিকা দেখলে চমকে উঠতে হয়। তালিকায় আছেন-- উদয় শঙ্কর, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, ডি এল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায়, শম্ভু মিত্র, তারাপদ চক্রবর্তী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়, উৎপল দত্তের মতো বিরল প্রতিভাবান ক্ষণজন্মা শিল্পী, স্রষ্টা, কৃতি প্রতিভাধর সব মানুষজন। শেষবারের মতো বাঙালির কপালে এই পুরস্কার জুটেছিল ১৪ বছর আগে, খালেদ চৌধুরীর সৌজন্যে।)