শাঁখা-সিঁদুরে সাম্য চান আজকের মেয়েরা!
[নিয়ম ভাঙারই গল্প। সমাজের প্রশ্নবিহীন চেনা ছককে দুরমুশ করার প্রয়াস। অচলায়তনে ঘা দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু বড় বেশি সরলীকৃত হয়ে গেল না?]


[নিয়ম ভাঙারই গল্প। সমাজের প্রশ্নবিহীন চেনা ছককে দুরমুশ করার প্রয়াস। অচলায়তনে ঘা দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু বড় বেশি সরলীকৃত হয়ে গেল না?]
অভিনয়ে -ঋতাভরী চক্রবর্তী, সোহম মজুমদার, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, সোমা চক্রবর্তী, মানসী সিনহা, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, সরেবদমন সোম, তনিকা বসু প্রমুখ
পরিচালনা – অরিত্র মুখোপাধ্যায়
চিত্রগ্রাহক – আলোক মাইতি
সম্পাদনা – মলয় লাহা
সঙ্গীত পরিচালনা - অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
শর্মিষ্ঠা গোস্বামী চট্টোপাধ্যায়: পরিচালক অরিত্র মুখোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’। এক মহিলা পুরোহিত, শবরীর সাম্যের চাহিদার গল্প। পৌরহিত্য পেশায় পুরুষতন্ত্র ও শাস্ত্রের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে জেহাদ।
এ ছবির বিষয়টিই খুব জোরদার ও অভিনব। মেয়েরা কেন শাঁখা-সিঁদুর পরবে, তাই নিয়ে যখন সমাজে চলে আসা নিয়মের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে অনেকেই সে সব বিসর্জন দিয়েছেন, তখন এই ছবিতে শবরী বলেন, ‘আমি তো শাঁখা-পলা. সিঁদুর নিয়ে যে ইমোশন রয়েছে, তার বিপক্ষে যাইনি, কেবল নিজের মাথা থেকে সিঁদুর নিয়ে স্বামীর কপালে তিলক পরিয়ে সাম্যটুকু চেয়েছিলাম’। এই একটা সংলাপেই হাজারো বিতর্ক শুরু হয়ে যেতে পারে। সাম্য কী? সাম্যের ধারণা, শাঁখা-পলা, সিঁদুরের পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাখ্যা নিয়ে এখনই হাজারো মত তৈরি হতে পারে। কিন্তু চিত্রনাট্যে কেবলই জোর দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু জনপ্রিয় মশলাদার সংলাপ লেখায়।না হলে, শবরীর প্রতিবাদে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলা, শ্বশুরবাড়িতে না জানিয়ে পুজো, বিয়ে বা শ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করতে যাওয়ার মত আপোস, ছবির উদ্দেশ্যকে আহত করে। খানিকটা বুঝি খাটো করে শবরীর লড়াইকেও।
শ্বশুরবাড়িতে শবরীর সবথেকে বড় সুবিধা যে বাড়ির পুরুষমহল তাঁর লড়াইয়ে পাশে আছে। স্বামী, ভাসুর, শ্বশুরমশাই সকলেই শবরীর পক্ষে। এমন কী ননদ রূপও। কিন্তু
শাশুড়ি ও পিসিশাশুড়ি নারীদের স্বাধীন চিন্তার বিপক্ষে। এখনও বাংলার ঘরে ঘরে এমনটা যে দেখা যায় না, তা নয়, কিন্তু যে শাশুড়ি জানেন যে, পিসিশাশুড়ি সত্ভাবে জ্যোতিষবিদ্যা করেন না, তিনি কি নিজের ছেলের বিয়ের কুষ্ঠি মেলানোর কাজ নিজের ননদকে দিয়ে করাবেন? এরকম বেশ কিছু ঘটনা নির্মাণে দুর্বল যুক্তি চিত্রনাট্যকে দুর্বলতর করে দেয়। শ্যামের মন্দিরের যে পুরোহিত জানেন যে, চক্রবর্তী বাড়িতে একজন পুরোহিত বৌমা রয়েছেন, তিনিই বা সেই বাড়ির মেয়ের বিয়ে থেকে পালিয়ে গিয়ে ঠিক কী অসুবিধা তৈরি করলেন, সেটাও বোঝা গেল না। খুবই স্বাভাবিক যে সবাই বিপদে পড়ে শবরীরই শরণাপন্ন হবেন, আর শবরীও ভালবাসার ননদকে ‘লগ্নভ্রষ্টা’ হতে দেবেন না।
চিত্রনাট্যে কতগুলো বিষয়কে একেবারে দাগিয়ে নিন্দা করা হয়েছে। এরমধ্যে কন্যাদান প্রসঙ্গের বিরোধিতা আছে। বলা হয়েছে, গরু ও কন্যা দান করা হয়। তাই কন্যাদান পণ্যদানের সমতুল্য। অথচ, আইনের দিকটাই খতিয়ে বলা নেই ছবিতে। বিয়ের পর বিবাহিত মেয়েদেরও বাবার সম্পত্তিতে সমান অধিকার আছে, সেই আইন পাস হয় ২০০৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। এই আইন পাসের পর কন্যাদানের প্রশ্নই তো আর ওঠে না। গল্পে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়েছে বলে জানা গিয়েছিল।ঋতুমতী মেয়েরা রজঃস্বলা অবস্থায় পুজোর কাজ করতে পারবেন কিনা।সেই প্রসঙ্গে এসেছে শবরীমালার কথাও। ঠাকুরঘরে বসে দেবীর অম্বুবাচী পুজো প্রসঙ্গও তুলেছেন শবরী। এনেছেন সারদা-রামকৃষ্ণের কথিত গল্পও। ছবিতে দ্রৌপদীর রজঃস্বলা অবস্থায় রাজসভায় অপমানের কথা উঠেছে। কিন্তু এগুলো আজকের দিনে অতি ব্যবহৃত উপমা। সমসময়ের জন্য আজকের দিনের একটি মেয়ে কি আরও একটু অন্যভাবে ভাববেন না! বরং শবরী যখন বলেন, সমাজের দূষিত ভাবনা শুষে নেওয়ার জন্য প্রচুর স্যানিটারি প্যাড লাগবে, তখন তাকে একটু ছোঁয়া যায়।
পৌরহিত্যে পুরুষ বনাম মহিলা লড়াই, জেনে বুঝে শবরীর যুদ্ধে হেরে যাওয়া, তার সংবেদনশীল মনের পরিচয় দেয়। দৃশ্যটিতে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় ও ঋতাভরী দ্বৈরথ দেখতে ভাল লাগবে। অভিনয়ে ঋতাভরী, সোহম মজুমদার, অম্বরীশ, সর্বদমন সোম যদি রিয়্যালিটির খুব কাছাকাছি হন, তাহলে সোমা চক্রবর্তী, মানসী সিনহা কে একটু চড়াদাগের লাগবে। আসলে তাঁদের চরিত্র চিত্রায়ন চিত্রনাট্যেই চড়া সুরে বাঁধা। বিশেষত অমরাবতীর (সোমা চক্রবর্তী)রাজনৈতিক মঞ্চে মুখ ফসকে ভুল বলে ফেলা এবং মঞ্চ ভেঙে যাওয়ার দৃশ্যগুলো একটু বাড়াবাড়ি লাগতে পারে। খুব একটা কমিক্যাল এফেক্ট জুড়ে দারুণ একটা হাসির বাতাবরণ তৈরি করেছে এমনটাও নয়।
বরং ছবির গানগুলো ভাল। সুরঙ্গনার গাওয়া ‘কোন গোপনে’ গানটি মনে থাকার মতই। ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়া লেগেছে’ গানটিও লগ্নজিতা খুব ভাল গেয়েছেন। সোমলতা ও উজ্জ্বয়িনীও সুনাম রেখেছেন।
নতুন পরিচালকের কাছে ছবির একটা নতুন ভাষা (ন্যারেটিভ)আশা করি আমরা। নতুন কিছু শট, নতুন এডিট প্যাটার্ন, নতুন একটা ফর্ম-সেদিকেই তাকিয়ে আছে বাংলা ছবি। অরিত্র সে রাস্তায় না হেঁটে উইন্ডোজের চেনা ছকেই হাঁটলেন। ছবি বক্স অফিস সাফল্যের কথা ভেবেই বোধকরি।