আলোর বিপরীতে স্বামী বিবেকানন্দ

স্বামী বিবেকানন্দের দেড়শতম জন্মশতবর্ষে নানা ষোড়শোপচারের সঙ্গে, অবশ্যই প্রয়োজন ছিল একটি পূর্ণদৈর্ঘের চলচ্চিত্রের। অনেক কিছুই তো হল, ছবিটাই বা বাকি থাকে কেন! তবে এমন নয় যে, স্বামীজিকে নিয়ে আমরা এই প্রথম আড়মোড়া ভেঙে উঠলাম। প্রত্যেক মধ্যবিত্ত বাড়ির স্টাডিরুমে এঁর ছবি অবশ্যই টাঙানো থাকে বাণীসমেত, যতই দরজার পেছনে ফিল্ম বা স্পোর্টসস্টারেরা শোভা পাক। প্রতিটি ছাত্র কোনও-না-কোনও বয়সে একবার স্বামীজি হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

Updated By: Feb 4, 2013, 08:01 PM IST

শর্মিলা মাইতি
রিভিউ: দ্য লাইট, স্বামী বিবেকানন্দ
রেটিং: *
স্বামী বিবেকানন্দের দেড়শতম জন্মশতবর্ষে নানা ষোড়শোপচারের সঙ্গে, অবশ্যই প্রয়োজন ছিল একটি পূর্ণদৈর্ঘের চলচ্চিত্রের। অনেক কিছুই তো হল, ছবিটাই বা বাকি থাকে কেন! তবে এমন নয় যে, স্বামীজিকে নিয়ে আমরা এই প্রথম আড়মোড়া ভেঙে উঠলাম। প্রত্যেক মধ্যবিত্ত বাড়ির স্টাডিরুমে এঁর ছবি অবশ্যই টাঙানো থাকে বাণীসমেত, যতই দরজার পেছনে ফিল্ম বা স্পোর্টসস্টারেরা শোভা পাক। প্রতিটি ছাত্র কোনও-না-কোনও বয়সে একবার স্বামীজি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বাংলা ও সর্বভারতীয় চলচ্চিত্র জগতেও একাধিক ছবি তৈরি হয়েছে স্বামীজিকে নিয়ে। অনেকে হয়তো জানেন না, প্রথম স্বামী বিবেকানন্দের ওপর ছবি প্রোডিউস করেছিলেন প্রয়াত অভিনেত্রী ভারতী দেবী। ১৯৩৪ সালের বাজারে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে। কিন্তু সে-ছবিতে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের সম্পর্ক দেখে দর্শকের একাংশ বলেছিল, `ওই বুড়োটা ছোঁড়াটাকে নিয়ে এত টানাটানি করছে কেন বল দেখি?` যাই হোক, ছয়ের দশকে মানুষের কাছে এই সম্পর্ক একটা স্বর্গীয় স্বীকৃতি পায়, যা তখনও ছিল না।
১৯৬৪ সালে নির্মিত মধু বসুর ছবি বীরেশ্বর বিবেকানন্দ তামাম বাঙালির মন ছুঁয়েছিল। অভিনেতা অমরেশ দাসের সঙ্গে স্বামীজির আদল নিয়ে হয়ত আজকের দর্শক কিঞ্চিত্ উষ্মাপ্রকাশ করতেই পারেন। কিন্তু অভিনয়ের গভীরতা প্রশ্নাতীত। যে ছবি ২০১৩ সালে মুক্তি পাচ্ছে, সে ছবির কাছে প্রত্যাশার কোনও শেষ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। পরিচালক টুটু সিনহা যে নবাগতকে নিয়ে এলেন স্বামীজির ভূমিকায়, তার মুখের আদল অনেকটাই মেলে নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। অবশ্য সামান্য লক্ষ্মীট্যারা। সেটাও ওভারলুক করা যায়। বাহবা অবশ্যই প্রাপ্য কাস্টিং ডিরেক্টরের। তাছাড়া, আরও কিছুদিন পিছিয়ে যদি পোস্টারের দিকে চোখ মেলি, সেটিও ধন্যবাদার্হ। প্রথম পোস্টারে শুধু একপাটি খড়ম। পুরাণ ও বাস্তবের আবাহন। রক্তমাংসের চরিত্র স্বামীজির ব্যক্তিত্ব দেবত্বে উন্নীত। তার পরের পোস্টারে স্বামীজির বেশে এক নতুন মুখ। প্রত্যাশাকে লালন করবার সেরা উপায়। সুন্দর বিজ্ঞাপন।

আসি মূল ছবিতে। মুখের আদল মিললেই যে স্বামীজির মতো চ্যালেঞ্জিং ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রে খাপে খাপ ঢুকে যাবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। দীপ ভট্টাচার্যের বডি ল্যাঙগোয়েজেই স্পষ্ট যে তিনি ক্যামেরার সামনে এখনও সড়গড় নন। মুখে মুখে প্রচারিত স্বামী বিবেকানন্দের বেশ কিছু কাহিনি জোড়া দিয়ে বানানো ছবির চিত্রনাট্য। প্রায় রিভাইজ না করেই নামানো হয়েছে। ছেলেবেলার বিলে গোলগাল গড়নের। জানালা দিয়ে শাড়ি-জামা-কাপড় দরিদ্রকে দান করার সেই বহুল প্রচলিত গল্প দিয়ে ছবি শুরু। কিশোর বয়সের বিবেকানন্দের চরিত্রে যাঁকে দেখি, তাঁর সঙ্গে বিবেকানন্দের চেহারার কোনও মিল নেই। অনায়াসে এই পর্ব থেকেই নবাগত দীপ ভট্টাচার্যকে ব্যবহার করা যেত। সে যাই হোক, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টি হতাশ করে তা হল, বিলে থেকে নরেন হওয়ার সময়টাকে অনাবশ্যক বেশি সময় নিয়ে দেখানো এবং আসল বিষয়, দ্য লাইট, মানে স্বামী বিবেকানন্দের আলো হয়ে ওঠার পর্বটি বড়ই ক্ষুদ্র। প্রায় একপাশে ঠেলে দেওয়া। মায়ের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে নরেনের সম্পর্ক, বাবার মৃত্যুর পর হন্যে হয়ে চাকরির খোঁজ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাপন্ন হওয়া, শ্রীরামকৃষ্ণের স্পর্শে বিশ্বরূপ দর্শন, এ সব কিছু নিশ্চয়ই বিবেকজীবনীর অন্যতম অংশ। বাদ দেওয়া যেত মাত্রাতিরিক্ত কিছু গানের সিকোয়েন্স। (এমনকি একটি বাঈজিনৃত্যও আছে যা না থাকলেও কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না)।

শ্রীরামকৃষ্ণের ভূমিকায় প্রেমাঙ্কুর চক্রবর্তী অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ভাবসমাধির সময়ে তাঁর কম্পমান শরীর, তুঙ্গ অভিব্যক্তি সত্যিই ছুঁয়ে যায় হৃদয়। বীরেশ্বর বিবেকানন্দ ছবিতে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়কেও ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন স্থানবিশেষে। এ প্রসঙ্গে জিভি আইয়ারের ছবি স্বামী বিবেকানন্দ-এ মিঠুন চক্রবর্তীর কথা বলা জরুরি। তারকার খোলস ছেড়ে শ্রীরামকৃষ্ণের চরিত্রচিত্রণ যে কী উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন তিনি, বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি তিনজন শ্রীরামকৃষ্ণকে রাখলে প্রেমাঙ্কুর মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে সমানে লড়তে পারতেন। বাধ সেধেছে অমনোযোগী স্ক্রিপ্ট। জিভি আইয়ারের সেই ছবিতে স্বামীজি হয়ে ওঠার চিত্রটি ছিল খুব সত্ এবং সাবলীল। অবশ্য তার পেছনে ঐতিহাসিক কারণও আছে। স্বামীজি যে-সময়ে দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শে দীক্ষিত। তাঁর অসমাপ্ত কাজ সারা ভারতে ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। কাজেই দক্ষিণী পরিচালকের কাছে, স্বামীজির দৃপ্ত, ব্যক্তিত্বময় দিকটিই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। অভিনেতা সর্বদমন ব্যানার্জিকে আমরা যেভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে স্বামীজির ভেতরে ঢুকে যেতে দেখেছি, তার পঞ্চাশ শতাংশও পেলাম না দীপ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। আবেগের ওভারটোনে হারিয়ে গেল নরেন থেকে স্বামীজি হয়ে ওঠার পর্ব। হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষার উচ্চারণে এখনও জড়তা রয়েছে দীপের। আমেরিকায় বিদেশিদের সঙ্গে ইংরেজি কথোপকথন এত ব্যাকরণভ্রান্তিতে ভারাক্রান্ত যে, বসে দেখার ইচ্ছেটাই চলে যায়। দক্ষিণের আইয়ার ব্রাহ্মণরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলেন স্বামীজিকে শিকাগো যাওয়ার অনুরোধ করতে, তখন তাঁরা দক্ষিণী টানে হিন্দিতে কথা বলেন। আধুনিক দর্শকের কাছে পরিচালকের এই অমনোযোগিতা ধরা পড়বেই। তেমনিই ধরা পড়বে, `নমোবিষ্ণু` করে সাজানো শিকাগো ধর্মমহাসভার সেট। থার্মোকলের দেওয়াল, কাঁচা তেলরং আর স্বল্পমূল্যের ভেলভেটের পর্দা, সর্বোপরি এমন একটি আন্তর্জাতিক ধর্মসভায় মাত্র গুটিকয় শ্রোতার উপস্থিতি, কোনও মতেই দর্শকমননকে তুষ্ট করতে পারবে না। কারণ, ইতিমধ্যে দর্শক অনেক ভাল সেট এবং টেকনোলজির ব্যবহার দেখে ফেলেছে। বাংলা ছবিতেই। স্ক্রিনটাইমে স্বামীজি মাত্র দু মিনিট বক্তৃতা দেন। সামনে ক্যামেরা বসিয়ে নিতান্ত দায়সারাভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যটি সেরে ফেলা হয়েছে। তেমনই হতাশ করে শিকাগো শহরে তুষারকণার বদলে পেঁজা তুলো উড়তে থাকার দৃশ্য। নাঃ, নিরাশা প্রায় তলানি ছুঁয়ে যায়।

হতাশ করার উপকরণ অসংখ্য। একটি দুটি উল্লেখ করে সংক্ষেপে সারছি। পরিচালক টুটু সিনহা কম বাজেটে কাজ করেছেন, সেটা কোনও কাজের কথা নয় এ যুগের নিরিখে। এমন একটি ছবি যেখানে, আমেরিকায় শুটিং অথবা বিশ্বাসযোগ্য সেট দরকার ছিল, সেখানে এতটা আপস করা মানে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও সম্ভাবনাময় বিষয়কে খুন করা। কদিন আগেই লাইফ অফ পাই ছবিতে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বদর্শনের একটি স্মরণযোগ্য থ্রি-ডি নমুনা দেখেছি। এখনও ঘোর কাটেনি। মানছি, টু-ডি তে সেই এফেক্ট আনা অসম্ভব। তবু শ্রীরামকৃষ্ণ যখন নরেন্দ্রনাথকে ঈশ্বর-অনুভব করাচ্ছেন, সেই ঝাপসা তৃতীয় মানের ভিএফএক্স আরও একবার মন খারাপ করে দেয়। মনে হয় আমরা প্রায় তিরিশ বছর পিছিয়ে গেলাম! তবে এ ছবি কিছুটা নম্বর পাবে গবেষণার কাজের জন্য। স্বামীজির সঙ্গে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের দেখা হওয়া, কিংবা জাহাজে জামশেদজি টাটার সঙ্গে কথোপকথন সেই রিসার্চ ওয়র্কেরই অঙ্গ। (দুঃখের বিষয়, জামশেদজি ও স্বামীজির এই দৃশ্যটিও দায়সারাভাবে ক্রোমায় শুট করা)। ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে সম্পর্কের গতিপ্রকৃতিতেও ওই রিসার্চ টিমের হাত আছে। না-হলেও-হয় এমনই একটি সারদা মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন গার্গী রায়চৌধুরী। বিশ্বজিত্ চক্রবর্তী বাদে বাকি কলাকুশলীরা নাটকের গ্রুপের। সবশেষে একটিই কথা, আরও আরও অনেক গুণ বেশি প্রস্তুতি ও অনুশীলন প্রয়োজন ছিল। সততা আর নিষ্ঠার অভাব পরতে পরতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

.