Rabindranath Tagore death anniversary: ছবির নাম 'বাইশে শ্রাবণ'-ই দেবেন, কেন অনড় ছিলেন মৃণাল সেন?
কবির মৃত্যুদিনে ঠিক কোন ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন তিনি?
নিজস্ব প্রতিবেদন: ৭ই অগাস্ট, ১৯৪১। ভোরবেলা সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে গেলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore)। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে পড়াশুনা করছিলেন এক যুবক। হঠাৎই ক্লাসের মাঝে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন প্রিন্সিপাল রেভারেন্ড অ্যালেন ক্যামেরন, জানালেন বিশ্বকবি আর বেঁচে নেই। এই দুঃসংবাদ শোনা মাত্রই সেই যুবক স্যারের অনুমতি না নিয়েই খালি পায়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জোড়াসাঁকোর দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। এই যুবকই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলা ছবির কিংবদন্তি পরিচালক মৃণাল সেন(Mrinal Sen)।
জোড়াসাঁকো পৌঁছে দেখলেন সেখানে লোকে লোকারণ্য, সবাই চেষ্টা করছে দোতলার সেই ঘরে পৌঁছতে যেখানে শায়িত আছে কবির দেহ। সকলের সঙ্গে তিনিও এগিয়ে গেলেন কিন্তু শোকে বিহ্বল মৃণাল সেন বুঝতেই পারলেন না কিভাবে তিনি ছাদে উঠে এসেছেন। সেদিন ভিড়ে কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না কারোর. সবাই যেন শোকে পাগল। এরকমই এক সময় হঠাৎই নীরবতা নেমে এলো। শহরের বড় বড় চিন্তাবিদরা কাঁধে বয়ে নিয়ে এলেন কবির শবদেহ। শোকমিছিলে পা মেলালেন যুবক মৃণাল সেনও। সেই মিছিল পাশ কাটিয়ে একটু এগিয়ে গেলেন তিনি , যাতে মিছিলের আগেই নিমতলা শ্মশানে পৌঁছতে পারেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে এক মর্মান্তিক দৃশ্যের সাক্ষী হলেন তিনি। সেখানে তখন মৃত শিশুর শবদেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শোকে বিধ্বস্ত পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক যুবক পিতা। আচমকাই শ্মশানঘাট ভরে উঠলো মানুষে। পুলিসের সমস্তরকম রক্ষণাবেক্ষন ভেঙে নিমতলা শ্মশানে তখন চরম বিশৃঙ্খলা। এরই মাঝে মানুষের পায়ে পায়ে হারিয়ে যায় সেই মৃত শিশুটি। সেই দৃশ্য ভুলতে পারেননি মৃণাল সেন।
আরও পড়ুন: চিত্রনাট্য না শুনেই এই ছবিতে অভিনয় করতে রাজি Ritwick Chakraborty
এই ঘটনার প্রায় উনিশ বছর বাদে ১৯৬০ সালে নিজের তৃতীয় পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেছিলেন পরিচালক। পরিচালক তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন এই ছবি তৈরি করার পর তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি একটি মহৎ ছবি তৈরি করেছেন যা আগে কখনও তাঁর মনে হয়নি। তাই ছবির নাম দিলেন 'বাইশে শ্রাবণ'। যে বাইশে শ্রাবণে কবি চলে গিয়েছিলেন, যে বাইশে শ্রাবণে মৃত শিশুর সৎকার করতে পারেননি তার যুবক পিতা, সেই বাইশে শ্রাবণেই ট্রেনে করে যাচ্ছিল তাঁর গল্পের বর-বৌ। বাইশে শ্রাবণ তাঁদের বিয়ের দিন। পরবর্তীকালে এই দুজন মানুষ একসঙ্গে জীবনের ভালো সময়,খারাপ সময় দেখেছে। একসঙ্গে মোকাবিলা করেছে ব্যক্তিগত নানা বিপর্যয়।
ছবির নাম যেহেতু 'বাইশে শ্রাবণ' আর এইদিন রবীন্দ্রনাথের তিরোধান দিবস, তাই অধ্যাপক অপূর্ব চন্দ ছবিটির নাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে মৃণাল সেন কবির প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে এই নাম রেখেছেন। বেশিরভাগ সদস্যরা কিছু না বললেও সেই সময় সেন্সর বোর্ডের এক সদস্যা অশোকা গুপ্ত সহ আরো দু-একজনের সঙ্গে তুমুল বাদানুবাদ হয়েছিল পরিচালকের। তিনি সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, তাঁর ছবির সঙ্গে কবির মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু তিনি যে দৃশ্য সেদিন নিমতলা শ্মশানে দেখেছিলেন তা তিনি ভুলতে পারেননি। সেই দিন সেই দৃশ্যক মনে রেখে তাঁর অধিকার আছে এই ছবির গল্পের মধ্যে দিয়ে মানুষের চোখের জল ধরে রাখার। তাঁকে ছেলেমানুষ, জেদি আখ্যা দিয়েই তাঁর ছবির নাম তেইশে শ্রাবণ রাখার অনুরোধ করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের কথায় কোনওভাবেই রাজি হননি পরিচালক। ছবির নাম নিয়ে বরাবরই অনড় ছিলেন মৃণাল সেন। কলকাতায় এই বিতর্কের সমাধান না হওয়ায় ছবিটি পাঠানো হয়েছিল দিল্লিতে। সেখান থেকেই ছাড়পত্র পায় 'বাইশে শ্রাবণ', যেখানে জাতীয় বিপর্যয়ে মিলে মিশে যায় ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে। এই ছবি নিয়ে পরিচালকের একটাই আক্ষেপ ছিল, সেই ছবি সেইসময় ব্যবসা করতে পারেনি।