দেশভাগের ‘পরাজয়’, মৃত মাধুরীর কণা শঙ্খচিলের ঠোঁটে
শর্মিলা মাইতি
শঙ্খচিল- ****
শুরুটাই বড় বুকে এসে বিঁধতে শুরু করে। গুলির শব্দ। কাঁটাতারের উপর দিয়ে এক কিশোরের ঝুলতে থাকা হাত। প্রতিদিন অন্নের লড়াই করতেই যাঁরা কাঁটাতার পেরিয়ে আসেন, তাঁদের প্রতিনিধি। আমরা তো সবে আটকাচ্ছি ৬৭-৬৮ বছর হল, আর ওঁরা পারাপার করছেন হাজার বছর ধরে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীবাহিনীপ্রধানের স্বীকারোক্তি। ইন্ডিয়া থেকে আসা যাত্রীবাহী নৌকো ফিরিয়ে দেওয়ার পর।
এমনই এক শব্দভেদী বাণ নিক্ষেপ করে শঙ্খচিলের শুরু। দেশভাগের মলিন স্মৃতির ধুলো যেন এ,ক ফুঁয়ে ঝাড়া হয়ে গেল। কিংবদন্তি পরিচালক গৌতম ঘোষ জানেন দর্শকের অজ্ঞতা। ঠিক কোথায় কুঠারাঘাত করলে দর্শকের মস্তিষ্ক ও মননে তৈরি হবে শঙ্খচিলের সেটিং। সংবাদ প্রতিনিধিকে রক্ষীপ্রধান দেখাচ্ছেন সিরিল রাডক্লিফের আঁকা সীমারেখার নমুনা। এক বাড়ির রান্নাঘর বাংলাদেশে, বাকি সব ঘর ইন্ডিয়ায়। গৃহস্থ দুটি দেশের পাসপোর্টই সঙ্গে রাখেন। কোথাও কাঁটাতারের নামে কাটা গাছের গুঁড়ি। কোথাও বা দুই পড়শি বন্ধু সান্ধ্য আড্ডায় বসেন অদৃশ্য সীমারেখা পার হয়েই। ঔপনিবেশিক উপমহাদেশের এই ঘেঁটে-গুলিয়ে যাওয়া আইডেন্টিটি কোনও কমিক কাহিনি নয়, নির্মম, রূঢ বাস্তব সত্য। তারের এপার-ওপার, কিম্বা নদীর এপার ওপার শুধুই নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসের। নদীর বুকে দেশের পতাকার খুঁটি লাগিয়ে বীরদর্পে যাঁরা কাঠপুতুলের মতোই টহলদারি করেন। আর বার বার এক অভিশপ্ত ইতিহাসের অনুশীলন করে চলেন। অনিচ্ছেয়, অপমানে। কিন্তু এসবই আসলে ঘটমান বর্তমান। আপনার আমার থেকে কিছু কিলোমিটার দূরত্বে এঁরা আছেন। যাদের প্রশাসনিক উপভাষায় বলা হয় অনুপ্রবেশকারী। প্রথম সিকোয়েন্সের শেষে রিপোর্টারের তাই ব্যঙ্গোক্তি- রাডক্লিফ বোধহয় নেশাগ্রস্ত ছিলেন!
নেশাগ্রস্ত ছিল সম্ভবত আরও দুই প্রজন্ম। তাই পার্টিশন নিয়ে শুধুু কোনও কাহিনি তৈরিই একমাত্র দায়িত্ব ছিল না। ছিল অ্যামনেশিয়ার গুরুভার। প্রধান চরিত্র পরিচয়ের আগে গৌতম ঘোষ জানিয়ে দিলেন আমরা ঠিক কোথায় আছি। শুধুই এক চলত্শক্তিরহিত পার্টিশন ড্রামা নয়, দৃষ্টিটা আরও দূরে ছড়িয়ে দিলেন। ঈশান ঘোষের ক্যামেরা বাঙ্ময়। কাঁটাতারের নির্দয়তা ধরলেন বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে। দেশভাগ যে বাঙালির কাছে নিত্যদিনের চরম সত্য, তীব্রভাবে বেঁচে আছে প্রতিদিনের জীবনে, সেই গৌরচন্দ্রিকা বড়, বড়ই প্রয়োজন ছিল। যেমন প্রয়োজন ছিল পিতৃপুরুষের লেখা দেশভাগের সময়ের চিঠি-ভরা, আরশোলায় কিলবিল করতে থাকা, ঝুরঝুরে ট্রাঙ্কটার। যে-দৃশ্যে বাদল পেড়ে আনছেন চিলেকোঠা থেকে। শুধু আঁতকে ওঠা ছাড়াও বাড়তি পাওনা এর গভীর রূপকার্থ।
কাহিনি দেশভাগ। চিত্রনাট্য পারাপার। চরিত্রেরা আসে এই সত্যের অনুসন্ধানে। মুনতাশির চৌধুরী বাদল। স্কুলের মাস্টারমশাই। মন তাঁর আকাশের মতোই স্বচ্ছ, সীমাহীন। যিনি ছাত্রদের পড়ান পরিযায়ী পাখির ছবি এঁকে। মাতৃভূমিকে আপন করে নেওয়ার বীজ বোনেন কিশোরমনে। তাঁর আকাশে ধ্রুবতারা একমাত্র কন্যা রূপসা। যে পারে আবেগ দিয়ে, আয়ু ভাগ করে নিয়েও মরা গাছকে জড়িয়ে ফুল ফোটাতে। নিষ্পাপ সাঁঝবাতিকে এতটুকুও মেক-আপে লালন করেনি। নদীর বাতাসে তিরতির করে কাঁপে পর্দা। তিনজনের সংসারে গান-আনন্দ-কবিতার অধিষ্ঠান। বর্ডারের মেলায় রূপসার আলাপ দোস্ত-র সঙ্গে। রাজস্থান থেকে আসা সীমান্তরক্ষী নকুল বৈদ। প্রতিটি চরিত্রের অবস্থান দেখুন, যে রক্ষীর সঙ্গে কাঁটাতারের আত্মিক সম্পর্কও নেই, সম্পূর্ণ অন্য ভোগোলিক অবস্থান থেকে এসেছেন, তাঁরাই টহলদার! এমন অনেক বৈষম্যই গোটা ছবিতে গেঁথে রেখেছে পুঞ্জ পুঞ্জ অভিমান। গৌতম ঘোষের ছবিতে নদী অন্য ভাষ্য তৈরী করে। পার থেকে পদ্মানদীর মাঝি হয়ে মনের মানুষ, সব ছবিতেই নিবিড় করে পাওয়া যায় নদীকে। এ ছবির নদী ব্যতিক্রমী। এ নদী এক অপরিপুষ্ট ইতিহাসের নির্বাক বাহক। দুঃখকে রাখে অশক্ত হৃদয়ের গভীরে।
বাংলাদেশের মাতৃভাষা বাংলার এক অন্য মিষ্টতা আছে। এ ছবির ভাষাও চরিত্র। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই পঠনপাঠন থেকে আমরা যেন অনেকটাই দূরে চলে এলাম। যতটা দূরত্ব, যতটা নির্লিপ্ততা তৈরি হয়েছে দেশভাগ নিয়ে। তেলের শিশির সেই উপমা আজ প্রায় নিঃশেষিত। তবু ভাষা, লাঞ্ছিত হতে হতে মৃতপ্রায়। রূপসার অ্যাম্বুলেন্সের পাশে উদ্দাম বাংলা ছবির আইটেম সং কর্কশভাবে বাজতে থাকার দৃশ্যই তার প্রমাণ।
এমনই প্রমাণ আরও আছে। অনুসন্ধিত্সু দর্শক খুজে পাবেন। প্রেমে আপ্লুত দর্শক খুঁজে নেপবেন জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। দেশভাগের মোচড়দেওয়া যন্ত্রণা ভোগ করতে করতেই দর্শক দেখবেন, ফুলের মতো মেয়েটা অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগেই সব শেষ। দর্শক দেখবেন, কলকাতার বুকেও কীভাবে কোন অলিগলিপথে বেঁচে আছে দেশভাগের পরাজয়ের ক্ষত। কত চোরাপথ। আইনী ভুলভুলাইয়ায় গুম হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
অপূর্ব অভিনয় কুসুমের। মনের মানুষ-এর পর আবারও মনের মানুষ হয়ে উঠবেন প্রসেনজিত্। অতি ধীরে তাঁর নায়কসুলভ ম্যানারিজমের আলখাল্লা খসে পড়ছে। বেরিয়ে আসছে অন্য এক মানুষ। সারা ছবিতে অসংখ্য মনে রাখার মতো দৃশ্যকল্প। কিন্তু শঙ্খচিল কোথায়? কোন বেশে সে এসেছে ধানসিঁড়ির তীরে? শঙ্খচিল আসলে আমাদের মনের আকাশে উড়তে থাকা স্বাধীন পাখির নাম। সিনেমার ইতিহাসে সংরক্ষণযোগ্য ছবি হিসেবে থাকবে শঙ্খচিল। নতুন প্রজন্মের কাছে পার্টিশনের দৃপ্ত আলেখ্য হিসেবে। প্রমাণ পেতেও তো পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হবে!