ইতিহাসের অলিন্দ্য মুর্শিদাবাদে
এই শহরের সঙ্গে সহবাস করে ইতিহাস। এই শহরের এলোমেলো রাস্তাঘাটে, ঘিঞ্জি গলির আনাচে কানাচে আয়েসি আড়মোড়া ভাঙে সে। তাকে জড়িয়ে ধরেই পরগাছার সুখী জীবনযাপন করে এই ছোট্ট শহর।
এই শহরের সঙ্গে সহবাস করে ইতিহাস। এই শহরের এলোমেলো রাস্তাঘাটে, ঘিঞ্জি গলির আনাচে কানাচে আয়েসি আড়মোড়া ভাঙে সে। তাকে জড়িয়ে ধরেই পরগাছার সুখী জীবনযাপন করে এই ছোট্ট শহর।
ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত অবিভক্ত বাংলার শেষ স্বাধীন রাজধানী মুর্শিদাবাদ। বিহার, ওড়িশা, বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁর সূত্রে নাম প্রাপ্তি ঘটেছিল এই শহরের। ১৭৭২ সালে মুর্শিদাবাদের মুকুট থেকে রাজধানীর পালক ছিঁড়ে নিয়ে গিয়ে কলকাতার টুপিতে বসিয়ে দিয়ে ছিল ইংরেজরা। দীর্ঘ ৫৫ বছরের রাজধানী গরিমার হঠাৎ পতন আপাত বিষণ্ণতা উপহার দিয়েছিল এই শহরকে। তবে সেই সব মন খারাপ দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্ধত অবস্থান আজও নিজের মত করেই। কাউকে পরোয়া না করার নবাবি মেজাজে এখনও এর বুক চিরে দৌড়ে বেড়ায় ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা গাড়ি। সৌজন্যে, সেই ইতিহাস। নদীর এ পাড়ে, লালবাগে, ইতস্তত নবাব-নামার চিহ্ন। ও পাড়ে, খোসবাগে বিশ্বাসভঙ্গের ক্ষত বুকে নিয়ে মাটির নিচে গভীর ঘুমে চির শয়ান বোহেমিয়ান নবাব সিরাজউদ্দোল্লা।
১৭৫৭-র ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মাত্র ৪০ কিমি দূরে এই শহরের মূল আকর্ষণ হাজারদুয়ারি। মীরজাফরের বংশধর হুমায়ুন ঝাকে তিন মহলা এই প্রাসাদ উপহার দেন ডানকান ম্যাকলিয়ড। ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের ধাঁচে তৈরী হাজার দরজার এই প্রাসাদের নশোটা দরজা সত্যিকারের। বাকি ১০০টা, শত্রুর চোখে ঝিলমিল লাগানোর জন্য। মোট ১১৪টি ঘরের বেশির ভাগই এখন বন্ধ। বাকিগুলো নিয়ে হাজারদুয়ারি এখন একটা আস্ত মিউজিয়ম। অবশ্যই নবাবি ইতিহাসে সমৃদ্ধ। নবাবদের বহু যুদ্ধের রক্ত মাখা অস্ত্রসস্ত্র, তেল রঙে আঁকা অমূল্য সব ছবি, হাতির দাঁতের আসবাবে সাজানো এই মিউজিয়ম। রয়েছে নবাব পরিবারের ব্যবহৃত ফিটন গাড়ি। হাজারদুয়ারির পাশেই আছে ইমামবরা। হাজারদুয়ারি আর ইমামবরার মাঝে রঙিন পাথরের ছোট্ট মসজিদ, মদিনা। রাতের আলোর হাজারদুয়ারি ছোট বেলার ভুলে যাওয়া ইতিহাস বইয়ের পাতাগুলোকে জীবন্ত করে দিয়ে যায়। মস্তিষ্কের ঘুমিয়ে থাকা স্মৃতি কোষগুলোকে এক ঝটকায় সক্রিয় করে তোলে।
হাজারদুয়ারির দরজার জানলার হিসাবের কঠিন সব অঙ্কগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই চলে আসা যায় আর এক ইতিহাসের সাক্ষী, জগৎ শেঠের বাড়ী। এলোমেলো ভাবে আশপাশেই রয়েছে নশিপুর রাজবাড়ি, কাঠগোলা বাগানের মতন আরও কতসব ইতিহাস চিহ্ন। আর একটু দূরে গেলেই পাওয়া যাবে কাশিমবাজার রাজবাড়ি।
মুর্শিদাবাদ শহরটা ইতিহাসে বেশ পোক্ত। কিন্তু ভূগোলে বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেনি কোনওদিনই। রাস্তাঘাটের `শারীরিক` অবস্থা অতি শোচনীয়। হিজিবিজি শহরের বুকে অপরিকল্পিত সিমেন্টের ইমারতের অকারণ ভিড়। নেই প্রয়োজনীয় পরিবহণ। রিক্সার প্যাঁ-প্যাঁ, ছিঁচকাঁদুনে গানের সঙ্গে টক্কর দেয় কালো ধোয়ার বেসামাল অটোর হর্ণের তারস্বর চিৎকার। এই সব কিছুই পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম এই পর্যটন কেন্দ্রকে আরও বেশি করে ইতিহাস সর্বস্ব করে তুলেছে। নবাবি আমলের পরন্ত সময়কেই আজও টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই শহর। কিন্তু এই সব কিছু নিয়েই বড় ব্যতিক্রমী-সুন্দর মুর্শিদাবাদ। বছরের যে কোন সময়ই ছোট্ট ছুটির হাত ধরে ১-২ দিনের পুঁচকে সফরে এক বুক ইতিহাসের সন্ধানে চলে আসাই যায় এখানে।