একটা হুইলচেয়ার আর একটু সময় বোধ হয় দিতেই পারত বিমানসংস্থাটি!
কড়াকড়ির ছলে অমানবিকতা মুম্বই বিমানবন্দরে
নিজস্ব প্রতিবেদন: দু'টি ছবি। পাশাপাশি। একটি রেলের। অন্যটি উড়ানের।
প্রথম ছবির ঘটনাস্থল বীরভূমের রামপুরহাট রেল স্টেশন। অসম থেকে হামসফর এক্সপ্রেসে চড়ে বেঙ্গালুরু যাচ্ছিলেন সেনাবাহিনীর এক দম্পতি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ ট্রেন মালদা স্টেশন ঢোকার আগে সন্তানের জন্ম দিলেন ওই মহিলা। সেই খবর রেল দফতরে দেওয়া হলে তারা দ্রুত সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলে। দায় এড়ায় না। দায়সারা গোছের ভাবও দেখায় না। রামপুরহাট স্টেশনে ট্রেন পৌঁছলে ওই মহিলা ও তাঁর সদ্যোজাত সন্তানের প্রাথমিক চিকিত্সা হয়। পরে রেলের উদ্যোগেই তাঁদের সযত্নে রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়!
দ্বিতীয় ছবির ঘটনাস্থল একটু দূরে। মুম্বই। সেখানে ছত্রপতি শিবাজি এয়ারপোর্টে বছরসাতষট্টির 'ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড' এক মহিলা কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসবেন বলে উড়ান ধরতে আসছেন। সঙ্গে আছেন তাঁর অ্যাটেন্ড্যান্ট। সকাল ১০:৪৫-এর উড়ান। তাঁরা ১০-টা ০৫-য়েই বিমানবন্দরে ঢুকে পড়েন। তবে, মহিলার জন্য হুইল চেয়ারের দরকার পড়ে। বিমানসংস্থার কর্মীরা এর ব্যবস্থা করতে পারেন না। মহিলার অ্যাটেন্ড্যান্টকে তখন ১২০০ টাকা খরচ করে একটি হুইল চেয়ার ভাড়া করে আনতে হয়। পুরো বিষয়টিতে ১০ মিনিট সময় লাগে। তখনও উড়ানের 'টেক-অফ' করতে প্রায় আধঘণ্টা দেরি আছে। এর পরই উক্ত বিমান সংস্থার তরফে তাঁদের টিকিট বাতিল করে দেওয়া হয়। পরের উড়ানের জন্য বিকল্প কোনও টিকিটের ব্যবস্থাও তাঁদের করে দেওয়া হয় না!
মাটি আর আকাশের যেমন তফাত, এই দু'টি ঘটনাতে সম্ভবত তেমনই ফারাক।
সেদিন রেল তার শিডিউল থেকেই সময় নিয়ে প্রসূতির দেখভাল করেছিল। 'লেট'-এর দোহাই দিয়ে মহিলাকে বিপন্ন রেখে ট্রেন হাঁকিয়ে চলে যায়নি তারা। নিশ্চয়ই অন্য যাত্রীদের দেরি হয়ে যাচ্ছিল, অসুবিধা হচ্ছিল; কিন্তু রেল তখন প্রসূতির বিষয়টিকেই 'প্রায়োরাটাইজ' করেছিল। মনে করেছিল, ঠিক সেই সময়ে ঠিক যে কাজটি ঠিক যে ভাবে করার দরকার, তারা ঠিক সেটা-সেটাই করবে। এবং করেওছিল। জরুরিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।
আজ, সোমবারের মুম্বইয়ের ঘটনাটিতে কিন্তু পুরোটাই অন্ধ-বন্ধ মনোভাব। মৈত্রেয়ী চন্দ নামের কলকাতামুখী ওই মহিলা যে বিমান সংস্থার 'ভ্যালিড টিকিটহোল্ডার', তাদেরই উচিত ছিল তাঁকে হুইল চেয়ার সরবরাহ করা। এটা তাদের 'জেনরোসিটি'ই নয়, এ একেবারেই শুকনো কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। একটি বিমানবন্দরে অসুস্থ অক্ষম মানুষের জন্য় এটুকু পরিষেবা আশা করাই যায়। অথচ, সেটুকুই ওরা দিতে পারল না। যাত্রীকেই তা নিজচেষ্টায় জোগাড় করে নিতে হল। অথচ, এর জন্য যেটুকু সময় খরচ হল, সেটাকে এমন ভাবে দেখানো হল, যেন তা যাত্রীর গাফিলতিজনিত। যদিও ওঁরা সময়মতোই পৌঁছেছিলেন বিমানবন্দরে। এবং ওঁদের বিমান ছাড়ার বেশ খানিকটা আগেই জরুরি কাজটা হয়ে গিয়েছিল, তথাপি ওঁদের টিকিট স্রেফ বাতিল করে দেওয়া হল!
কী হত, যদি একটা হুইল চেয়ার দেওয়া যেত মৈত্রেয়ীকে? কী হত, যদি একটু সময় নিয়েই তাঁকে সযত্নে উড়ানে তুলে যেওয়া যেত? তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেওয়া যায়, এই কাজটুকু করতে সমান্য একটু 'লেট' হত, সেটুকু কি সংবেদশীল সহযাত্রীদল মেনে নিতেন না? না কি, সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মের কড়াকড়ি দেখিয়ে নিজেদের পেশাদারি মুখটা বেশি করে দেখানোর গভীর বাসনাই তাদের দিয়ে এই অমানবিক অর্থহীন কাজটি অবলীলায় করিয়ে নিল?
দু'টি ছবি। পাশাপাশি। একটি রেলের। অন্যটি উড়ানের। একটি মানবিক। অন্যটি অমানবিক। একটি সহমর্মিতার। অন্যটি নির্মমতার।
also read: উত্তেজনা থাকলেও লাদাখ নিয়ে চিন্তার কারণ নেই, আমরাও পুরোপুরি তৈরি:বিপিন রাওয়াত