সৌমিত্র সেন
চলে গেলেন প্রায় শতবর্ষে উপনীত ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ। ১৯২৩ সালে জন্ম বরিশালের সিদ্ধকাঠি গ্রামের জমিদার পরিবারে। রাধিকারঞ্জন গুহবক্সীর পুত্র রণজিৎ দেখতেন তাঁর মাঠের খেলার সঙ্গী বা তাঁদের বাড়িতে আসা মানুষজনের একটিই পরিচয়— প্রজা! কেন, প্রজা কেন এঁরা, কার প্রজা? এই ছোট্ট জিজ্ঞাসা থেকেই যেন কী ভাবে এক ভাবী ইতিহাসবিদের জীবন ও দর্শন কর্ম ও প্রক্রিয়া বরাবরের জন্য চিহ্নিত হয়ে গেল। হবে নাই-বা কেন? স্বয়ং রণজিতের প্রিয় উক্তি ছিল মার্ক্সের 'নাথিং হিউম্যান ইজ এলিয়েন টু মি'! কথাটি। তা হলে, মানুষের সঙ্গে যা-যা সম্পর্কিত তা সব কিছুই তো তাঁর বিষয় হতে বাধ্য। হয়েছিলও তাই।
যদিও একটি বড় অংশের মানুষের কাছে তাঁর পরিচয় শুধুই নিম্নবর্গের ইতিহাসের ধারণার উদগাতা হিসেবেই। অবশ্যই তাই। কিন্তু শুধু ওইটুকুই তো নয়। ওইটুকুতে আঁটানো যায় না রণজিতের মতো সদা-সৃজনশীল এক বিশাল মাপের ইতিহাস-ব্যক্তিত্বকে। তাঁর প্রথম বই ছিল 'আ রুল অফ প্রপার্টি ফর বেঙ্গল'। সমসাময়িক ইতিহাসবিদেরা বা অন্য ক্ষেত্রের বিশিষ্টেরা যে কয়েকটি বই পড়া বাধ্যতামূলক বলে মনে করতেন সে সময়ে (নিশ্চিত এখনও), তাঁর মধ্যে অবশ্যই থাকত এই বইটি।
তাঁর সারাজীবনের কাজ দিয়ে রণজিৎ দেখান, জমিদার কী ভাবে শোষকে পরিণত হয়; রণজিৎ দেখান কী ভাবে ব্যবসা বা ব্যবসাগিরি, বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য, পাশাপাশি প্রকৃতিতন্ত্র ইত্যাদির গভীর প্রভাব পড়েছিল আঠারো শতকের কৃষিনীতি তৈরিতে। তিনি দেখান-- উপনিবেশবাদের প্রয়োজন, অবাধ বাণিজ্য-পরিকল্পনা, নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাময়িক নিয়মভাবনা কী ভাবে মূলগত লক্ষ্যের ঈপ্সিত ফল থেকে তাকে বিচ্যুত করে। আর কীভাবে তার ফল ভোগ করে প্রান্তিক মানুষ, কৃষিজীবী মানুষ। আর তাঁর এই সব দেখিয়ে দেওয়ার কেন্দ্রে, কোনও তত্ত্ব নয়, নীতি নয়, সমীক্ষা নয়, আসলে বাস করে মানুষ।
তাই রণজিৎ গুহর চিন্তা ও তার লিপিবদ্ধ রূপ কোনও দিনই কোনও বিশেষ বর্গে আটকে থাকেনি। বারবার তিনি ইতিহাসচর্চায় বেড়া ভেঙে দিয়েছেন। অবলীলায় ভেঙেছেন, বড় স্বাভাবিকতাতেই তাঁকে ভাঙতে হয়েছে, কেননা তিনি তো আদতে মানুষের কাছেই ফিরে যেতে চান, ফিরে যান-- মানুষের সঙ্গে অন্বিত যা-কিছু, সেসব তো তাঁরও একান্ত অন্বিষ্ট।