তন্ত্রচূড়ামণিতে ৫১ পীঠের তালিকায় কাঞ্চী নামের এই জায়গা ২৮ তম সতীপীঠ, আজকের নাম কঙ্কালীতলা
তন্ত্রচূড়ামণিতে ৫১ পীঠের তালিকায় কাঞ্চী নামের এই জায়গা ২৮ তম সতীপীঠ, আজকের নাম কঙ্কালীতলা
ধ্রুবজ্যোতি অধিকারী, কমলাক্ষ ভট্টাচার্য: বোলপুর শহর থেকে প্রায় ন'কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্বে সবুজের সমারোহ। নগরায়নের হাত ধরে এখন যদিও তা অনেক পাতলা... তবু যেটুকু আছে, তার সৌন্দর্য অপার। লাল মাটির আদর আর প্রশান্ত বনময় পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে আঁকেবাঁকে চলা আমাদের ছোট নদী কোপাই। রাঙামাটির দেশে মাঠ ঘাট বনবাদাড় পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া শক্তিপীঠ কঙ্কালীতলা। মূল প্রবেশ তোরণ পেরোতেই চোখে পড়ল বেশ ভিড়। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও মাতৃদর্শনে এসেছেন অনেকে।
বহুদিন বাদে পুণ্যার্থী সমাগমের চেনা ছবি ফিরতেই মাধুকরীর আশায় হাজির হয়েছেন এঁরা। খুলেছে দোকানপাট। হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে পীঠভূমির বুক জুড়ে বসেছে বিকিকিনির আসর। প্রেম, ভক্তি, আদর, অনুরাগ --- একাকার হয়ে যাচ্ছে সব। প্রবেশপথ পেরিয়ে মূল মন্দির প্রাঙ্গণে যখন দাঁড়ালাম, তখন মাতৃনামে মুখর আকাশ বাতাস।
যেন হয়ে গেল আত্মশুদ্ধির স্নান। তন্ত্রচূড়ামণিতে একান্নপীঠের তালিকায় কাঞ্চী নামের জায়গাকে আঠাশতম সতীপীঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কঙ্কালীতলা আজকের নাম। প্রাচীন তীর্থ হিসেবে এর নাম ছিল কাঞ্চীদেশ। এখানে দেবী হলেন দেবগর্ভা। তাঁর ভৈরব হলেন রুরু।
আরও পড়ুন: সূর্যোদয়ের পর প্রস্তর বিগ্রহের অঙ্গরাগ, চারচালা মন্দিরের গর্ভৃগৃহে কালিকারূপী দেবী নলাটেশ্বরী
পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে, এখানে সতীর অস্থি বা কঙ্কাল পড়েছিল। সেই কারণে পীঠের নাম হয় কঙ্কালীতলা। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন, এখানে সতীর কটিদেশ বা কোমরের অংশ পড়েছিল। মোদ্দা কথা হল, অনেক শক্তিপীঠের মতন এই শক্তিপীঠ নিয়েও শাস্ত্র ও শাস্ত্রজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। মন্দিরের সেবাইত ও স্থানীয় তন্ত্রসাধকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, সতীর কটিদেশ পড়ার তত্ত্বই এখানে বেশি জোরাল।
গুপ্ত তন্ত্র সাধনার জন্য প্রসিদ্ধ কঙ্কালীতলা। শক্তিপীঠে এই কুণ্ডকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে দেবী মাহাত্ম্য। কঙ্কালীতলায় আগে কোনও মন্দির ছিল না। শুধুমাত্র এই জলাশয়টিই ছিল। লোকশ্রুতি, কুণ্ডের মধ্যে কয়েকটি প্রস্থর খণ্ড আছে, যেগুলিকে সাধকরা দেবীর দেহের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ওই প্রস্থর খণ্ডগুলি কুড়ি বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়। পুজোর পর সেগুলিকে পুনরায় কুণ্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কঙ্কালীপীঠের মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। রয়েছে শ্মশানকালীর বেশ বড় একটি বাঁধানো ছবি। দেবগর্ভার উদ্দেশ্যে এই ছবিতেই নিত্যপুজো হয়।
সতীকুণ্ডে শায়িত মহাদেবীর রক্ষকের ভূমিকায় বিরাজ করছেন কঙ্কালী পীঠের ত্র্যম্বক। পীঠভূমির প্রাঙ্গনে যে বটগাছ রয়েছে, তার শীতল ছায়ায় রুরু ভৈরবনাথের মন্দির। শান্তিনিকেতনে বেড়াতে এলে কঙ্কালীতলা মন্দিরে আসেন না বা পুজো দেন না, এমন মানুষ খুব কমই মিলবে। পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় তো বটেই, এই শক্তিপীঠ স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।
বিশাল এই বটগাছ, পাশে আম কালোজাম আর বাবলা বনের বাহারি সমাবেশ। বহুপূর্বে নাকি তপোবনের মতো পরিবেশ ছিল কঙ্কালীতলায়। অজয় উপত্যকার এই তীর্থভূমিতে পা রেখেছিলেন জৈন ধর্মগুরু মহাবীর। মহাবীরের জন্ম গৌতম বুদ্ধের জন্মের কয়েক বছর আগে। বাহাত্তর বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। ঐতিহাসিকদের অনুমান, সেই হিসেবে আড়াই হাজার বছরের বেশি সময় আগে কঙ্কালীপীঠে এসেছিলেন মহাবীর। কথিত আছে, এককালে ঋষি কনখলের আশ্রমও ছিল এখানে। তন্ত্রচূড়ামণি ও শিবচরিতে এই স্থানকে কেন কাঞ্চীদেশ বলা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা মিলল শিক্ষক কৌশিক মজুমদারের কাছে। সন্ধে হতেই বদলে গেল পরিবেশ। তন্ত্রমন্ত্রের আভিচারিক ক্ষেত্র হিসেবে প্রকাশ পেতে থাকল কঙ্কালীতলা।