"ভাদুর আমার কী হল, মাস্ক পরে বেরুতে হল", করোনার ছোঁয়া প্রাচীন লোকগানেও
ভাদুর কাহিনিও কম আকর্ষক নয়। মানভূম রাজবংশের পঞ্চকোটরাজ নীলমণি সিংদেওর তৃতীয় কন্যা ভদ্রাবতী। আত্মীয়-পড়শিরা ডাকতেন ভাদু বলে
ভাদুর আমার কী হল
মাস্ক পরে বেরুতে হল
কী জ্বালায় পড়েছো ভাদু গো
কী করি গো দেশেতে এল করোনা...
শতাব্দী প্রাচীন বাংলার অন্যতম লোকগানে মহামারী করোনার কথা ঢুকে পড়ল। লোকগানের সুরে সুরে ভাদু গাইয়ের দল করোনা থেকে বাঁচার উপায় বাতলে দিচ্ছে । ছোট্ট ভাদুকে মাস্ক পরিয়ে গ্রামের পথে প্রান্তরে চলছে ভাদু বন্দনা। করোনা থাবা বসাল প্রাচীন লোকগান ভাদুর ধারার উপর। কাটোয়ার চুরপুনি গ্রামের দাসপাড়ায় ভাদুর দল সমস্বরে গেয়ে উঠছে লোকগানের সুরে করোনা সচেতনতার গান।
আদিগন্ত নীল আকাশের নীচে ধানক্ষেতের সবুজ আলপথ বেয়ে হেঁটে চলেছে প্রান্তিক মহিলাদের দল। কোলে মাটির তৈরি ছোট্ট ভাদু। নদী পার হয়ে তাঁরাই গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলার প্রাচীন লোকগান ভাদু । এই-গানের সঙ্গে কৃষির নাড়ির যোগ। তাই সেই লোকগান গ্রামগঞ্জের শ্রোতার তনুমনে লহর তোলে। এবার ভাদু গানের নতুন সংযোজন করোনা কথা। মিঠেল রোদে ভাদুর মূল গানের সুরে প্রমিলাবাহিনী গেয়ে চলেছে করোনা থেকে বাঁচার কথা। কারণ করোনা কালে ভাদু নিজেও মাস্ক পরেছে। হোক না সে মাটির পুতুল। তবুও তো ভাদু বাড়ির কন্যা তারও মৃত্যু ভয় আছে!
মাঠে মাঠে ধান পোঁতা সারা। অখণ্ড অবসরে প্রত্যন্ত বাংলার বিনোদনের লোকগান ভাদু আজও এভাবেই টিকে রয়েছে রাঢ়বাংলার পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম ,মুর্শিদাবাদ ,নদিয়ার বিভিন্ন গ্রামে। মাসভর মহড়ার পর সংক্রান্তির আগে ভাদু ঠাকুরকে কোলে নিয়ে গ্রামে গ্রামে নেচে গেয়ে চিত্ত বিনোদন করেন শিল্পীরা। ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে লড়ে টিকে রয়েছে লোকসংস্কৃতির এই বিনোদিনী বলয়টি।
ভাদু হলেন শস্যকন্যা। ভাদু ব্রত পালনে নাকি মাঠঘাট সুফলা শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে! এই বিশ্বাসে ভর করে গ্রামের অন্ত্যজ শ্রেণির মহিলারা আজও ভাদু বন্দনা করেন। কৃষিজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাদুগানেও পল্লীবাংলার জীবন-জীবিকার নানাস্তরের স্পর্শ বহ্নিমান। সেই ধারাকে বজায় রাখতে গিয়ে পালাকার এবার ভাদুগানের মধ্যে অতিমারী করোনার কথা যোগ করেছেন।
ভাদুর কাহিনিও কম আকর্ষক নয়। মানভূম রাজবংশের পঞ্চকোটরাজ নীলমণি সিংদেওর তৃতীয় কন্যা ভদ্রাবতী। আত্মীয়-পড়শিরা ডাকতেন ভাদু বলে। ভাদুর বিয়ে ঠিক হয়। ছাদে উঠে আকাশপানে চেয়ে ভবিষ্যতের সুখে গুনগুন করে ভাদু। সেই সুখ-সুর নহবতখানার সানাইয়ে দোল খায়। মনে মনে ছবি আঁকে স্বপ্নের সঙ্গীর।
আরও পড়ুন- যাঁরা তর্পণের মঞ্চ ভাঙলেন, তাঁদের উর্দি খুলে নেব, বিস্ফোরক রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বপ্নের সমাধি হয়ে যায় একদিন। ডাকাতের হামলায় প্রাণ হারান ভাদুর হবু বর। এরপর ভাদু রাজ্যবাসীর কল্যাণে নিজের জীবনখাতায় ইতি টানেন। কোথাও ভাদুগানের স্বরলিপিতে সেই বিষাদ জড়িয়ে থাকে। ভাদুর মূর্তিকে বাড়ির ছোট্ট মেয়ের আসন দিয়ে গান বাঁধা হয়ে থাকে। সেই ধারার উপর নির্ভর করে এবছর করোনা কথা ভাদু গানে ঢুকেছে বলে পালাকারদের দাবি।