গ্রামে হোক কলেজ, চান পদ্মশ্রী ভূষিত ২ টাকা বেতনের 'মাস্টারমশাই'
সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের বলেন, "পদ্মশ্রী মঞ্চে পৌঁছে যদি সুযোগ পাই সেখানেও এই ছেলে-মেয়েগুলোর জন্য কলেজ তৈরির অনুরোধ করব।’’
নিজস্ব প্রতিবেদন:২০২১-র পদ্মশ্রী পেলেন 'মাস্টারমশাই' সুজিত চট্টোপাধ্যায়। তিনি শিক্ষা দেন। যেখানে কোনও টাকা পয়সার হিসেব নেই। নামমাত্র গুরুদক্ষিণার বিনিময়ে শিক্ষিত করেন গ্রামের হত দরিদ্র-দুঃস্থ ছেলে-মেয়েদের।
'মাস্টারমশাই' পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগরের বাসিন্দা। ছেলে মেয়েদের পড়ালেই যাঁর মন শরীর ভাল থাকে। সকাল থেকে প্রায় ৩০০ পড়ুয়াকে পড়ান সুজিতবাবু। পড়ুয়া পিছু ‘গুরুদক্ষিণা’বছরে মাত্র ২ টাকা। সঙ্গে চারটি ছোট চকোলেট।
দিনটি সোমবার, অর্থাৎ গতকাল। ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টে বেজে ৩০। বেজে ওঠে সুজিতবাবুর নাতি উৎসব চট্টোপাধ্যায়ের মোবাইল ফোন। সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ফোন তোলার পর পুরুষ কণ্ঠে ওপার থেকে বলেন, 'দিল্লি থেকে ফোন করছি। আপনি কি সুজিত চট্টোপাধ্যায়? আপনি আদিবাসী গরিব দুঃস্থ ছেলে মেয়েদের পড়ান'? উত্তরে আমি হ্যাঁ বলি। কিন্তু ওপার থেকে হিন্দি ভাষায় কথা বলছিলেন। আমি সড়গড় নই। তাই মেয়ের ফোন নম্বর দিই তাঁকে।
মেয়েকে তাঁরা ফোন করে জানায়, 'আমি পদ্মশ্রী পাচ্ছি। মার্চের শেষে অনুষ্ঠান। দিল্লি যেতে হবে। সব আয়োজন তাঁরাই করবে'। কিন্তু এই সংবাদ ভুঁয়ো নাকি সত্যি তা যাচাই করতে রাত ৯.৩০ বেজে যায় মাস্টারমশাইয়ের পরিবারের। কারণ, সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের কথায় 'গ্রামাঞ্চলের মাস্টারমশাইয়ের কথা কে বা মনে রাখে?'
বেতন শুধুমাত্রই ২ টাকা আর ৪ টে চকোলেট! কোন মানসিকতা থেকে এই সিদ্ধান্ত?
ZEE 24 Ghanta ডিজিটালকে সুজিত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ' ৪০ বছর শিক্ষাকতা করেছি রামনগর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ২০০৪ এ অবসর নিয়েছি। তারপর ভাবছিলাম কী করব? তখন জঙ্গলমহলের ভিতর থেকে আরও দূর দূর গ্রাম থেকে কিছু ছেলে মেয়ে আসে। তাঁরা আমাকে পড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু বেতনের কথা উঠতেই তাঁদের মুখ শুকিয়ে যায়। বুঝতে পারি ওঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তখন বলি, আচ্ছা ১ টাকা আর চকোলেট দিলেই হবে। ব্যাস্, সেই থেকে শুরু। প্রথমে ৫০, এখন প্রায় তিনশোরও বেশি ছেলে মেয়েদের পড়াই। তবে পড়ুয়ার মধ্যে মেয়ের সংখ্যাই বেশি'।
নবম থেকে দ্বাদশ ও কলেজের প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রীদের পড়ান সুজিত চট্টোপাধ্যায়। মাস্টারমশাই বলেন, 'আমি পড়িয়ে ভালো থাকি। শুধুমাত্র শিক্ষা দিয়ে আলোকিত করতে চাই ওই দীন দরিদ্র ছেলে-মেয়েগুলোর ভবিষ্যৎকে'।
তবে আমি একটা আর্জি জানাতে চাই। বিভিন্নমহলেও জানিয়েছি, "আমাদের এই এলাকায় যদি একটা কলেজ করে দেওয়া হয়। আমার কাছে সেই দূর গ্রাম, জঙ্গলমহলের ভিতর থেকে পড়তে আসে। তাঁরা আমায় জানায়, 'সকালে কাঠ কুড়িয়ে, আপনার কাছে পড়তে আসি। তারপর বাঁদুর ঝোলা ঝুলে রোজ ২৫ কিলোমিটার দূরে কলেজ যেতে হয়। পড়ার সময় যাতায়াতেই চলে যায়। ওঁরা এর মধ্যেও ভাল রেজাল্ট করে। কিন্তু এখানে কাছাকাছি জায়গায় একটা কলেজ হলে খুব সুবিধা হয়। বিভিন্ন মঞ্চে যেখানে আমাকে সম্মান দেওয়া হয়েছে, সেখানে গিয়েও আমি উপস্থিত মন্ত্রীদের কাছে আর্জি জানাই কলেজের। পদ্মশ্রী মঞ্চে পৌঁছে যদি সুযোগ পাই সেখানেও এই ছেলে-মেয়েগুলোর জন্য কলেজ তৈরির অনুরোধ করব।
গোটা গ্রাম এখন মাস্টারমশাইয়ের জন্য গর্বিত। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায় মাস্টারমশাইয়ের জন্য দেশের মানুষ জানতে পারলেন, পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগরের কথা। সুজিত চট্টোপাধ্যায় বলেন, "গ্রামাঞ্চলের এক জন মাস্টারমশাইয়ের কথা ওঁরা ভেবেছেন, আমি কৃতজ্ঞ।"