সাঁজের আটচালা: প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো বাড়ির পুজো

বর্তমানে থিম ও বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে না গিয়ে এখনও কিছু বনেদি বাড়ির পুজো টিকে আছে শতাব্দী পেরিয়ে। তেমনই একটি শতাব্দী প্রাচীণ বনেদি বাড়ির পুজোর ঠিকানা সাঁজের আটচালা।

Updated By: Oct 16, 2018, 11:17 AM IST
সাঁজের আটচালা: প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো বাড়ির পুজো

সুদীপ দে: এখন দুর্গাপুজো মানেই বারোয়ারি পুজো। শহর, মফস্বলের ওলিতে গলিতে এখন শুধুই থিমের লড়াই। কিন্তু বর্তমানে থিম ও বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে না গিয়ে এখনও কিছু বনেদি বাড়ির পুজো টিকে আছে শতাব্দী পেরিয়ে। তেমনই একটি শতাব্দী প্রাচীণ বনেদি বাড়ির পুজোর ঠিকানা সাঁজের আটচালা।

হাওড়া শিবপুর বাজার থেকে মন্দিরতলার দিকে এগোলেই হিন্দু গার্লস স্কুল। সেখান থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে মিনিট খানেকের হাঁটাপথেই ‘সাঁজের আটচালা’। হাওড়ার শিবপুরের রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো শুরু হয় ১৬৮৫ সালে (মতান্তরে ১৬৮১ সালে)। এই পুজো শুরু করেন রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী। স্বপ্নে মায়ের আদেশ পেয়ে রামব্রহ্ম বাড়িতে এই পুজো শুরু করেন। এ পুজো আসলে মা চন্ডীর পুজো। বর্তমানে এলাকায় বারোয়ারি পুজোর রমরমা হলেও তিনশো বছর পেরিয়ে এসেও শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ীর পুজো এখনও সমান জনপ্রিয়। পুজোর আগের সেই রাজকীয় জৌলুস হয়তো আর নেই, তবে নিয়ম নিষ্ঠা এবং আড়ম্বর যথাসম্ভব বজায় রেখে চলেছেন ‘শ্রী শ্রী দূর্গা-কালীমাতা এসেস্ট’ – শিবপুরের রায়চৌধুরী পরিবার।

রায়চৌধুরী পরিবারের এই পুজো ‘সাঁজের আটচালা’ নামেই এলাকায় পরিচিত। সাবেক তিনচালা ডাকের সাজের মায়ের মূর্তি এই পুজোর বৈশিষ্ট্য। সাঁজের আটচালায় মায়ের বোধন হয় মহালয়ার আগের নবমী তে। সদিন থেকেই ‘সাঁজের আটচালা’-র পুজোর সূচনা। বেলুড় মঠে যে রীতিতে পুজো হয়, সেই রীতিই অনুসরণ করা হয় এখানেও। অর্থাত্, সাঁজের আটচালায় পুজো হয় বৃহন্নন্দীকেশ্বর মতে। দো-মেটে প্রতিমা সম্পন্ন হওয়ার পরে অঞ্চলের বহু ব্রাহ্মণ আমন্ত্রিত হন এই বাড়িতে। মায়ের মূর্তি দর্শন করে তাতে কোনও ত্রুটি আছে কি না, তা তাঁরা দেখেন। নিখুঁত মূর্তির ছাড়পত্র পাওয়ার পরেই শুরু হয় চূড়ান্ত পর্বের মূর্তি গড়ার কাজ। এ বাড়িতে পুজোর জন্মলগ্ন থেকেই এ প্রথা চলে আসছে।

রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোয় মায়ের মূর্তির সামনে কোনও ঘট বাঁধা হয় না। ঘট বাঁধা হয় আটচালা সংলগ্ন একটি বেলগাছে। এই বেলগাছের জন্য একটি আলাদা ঘরও আছে। এই বেল-ঘরের ছাঁদ ফুড়ে গাছটি উঠে গিয়েছে। পরিবারের বিশ্বাস, এই বেলগাছ দিয়েই মর্তে মা’র আগমন হয়। পুজোতে এখনও বলি প্রথা চালু আছে। সপ্তমীর দিন একটি এবং অষ্টমী ও নবমীর দিন দুটি করে পাঁঠা বলি হয়।

নবমীর দিন হোম সম্পন্ন হলে, হাঁড়িকাঠ উঠিয়ে বাড়িতে পংক্তিভোজনের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়াও নানা রকম মিষ্টান্ন, ঘরে তৈরী নারকেল নাড়ু, বিভিন্ন রকম ফল তো থাকেই। ‘সাঁজের আটচালা’র পুজোর দায়িত্বে থাকেন অরুণ রায়চৌধুরী। অরুণবাবু জানান, আগের মতো আড়ম্বর না থাকলেও ৩৩৭ বছর ধরে যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো চালিয়ে যাচ্ছে রায়চৌধুরী পরিবার। শুধু পরিবারের সদস্যরাই নয়, অঞ্চলের বহু মানুষ সাঁজের আটচালায় ভিড় জমান শতাব্দী প্রাচীণ এই পুজো দেখতে।

দশমীতে পুজোর শেষে পুজোর ঘট বা মায়ের মুকুট— কোনটিরই বিসর্জন হয় না। মায়ের মুকুট আর জলভরা ঘট চলে যায় অনতিদূরের পারিবারিক মন্দির ব্যাতাই চন্ডীর মন্দিরে।

হাওড়া শিবপুরের মন্দিরতলার প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো রায়চৌধুরী পরিবারের এই ‘সাঁজের আটচালা’। নাগালের মধ্যে ইতিহাস ছোঁয়ার হাতছানি। বারোয়ারি পুজোর ভিড়ে ব্যাতিক্রমী রায়চৌধুরী পরিবারের ‘সাঁজের আটচালা’।

.