আজগুবি
অনেক কথাই তো মনে আসে, সেগুলো সব লিখে রাখতে পারলে হয়তো ভালই হয়, কোনটা কবিতা, কোনটা গল্প, কোনটা সংলাপ হয়ে যেত। কিন্তু কে লিখবে? সে একটা বড় পরিশ্রমের কাজ, অত ঝক্কি আমার পোষায় না, তাই লেখক, বা কবি কোনটাই আমার পক্ষে হওয়া সম্ভব নয়। সোজা কথায় আমি বেশ কুঁড়ে। মানে যেটা না করলেই নয় সেটাই আমি করি। তারথেকে বাড়তি কাজে আমার ব্যাপক অনীহা। অফিসের নির্দেশে আমাকে লিখতে হয়, বাধ্য হয়েই লিখি। তারজন্য অফিস টাকা দেয়। না বোলার উপায় নেই। আমার যেটা ভাল লাগে সেটা হল কথা বলতে, আমার ভালো লাগা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে, কথা বলতেই অনেক ভাবনা আসে, কিন্তু সে আর থাকে কতক্ষণ? আবার হারিয়ে যায়। ভাবনার স্রোতের মধ্যেই মন ডুবিয়ে বসে থাকি।
স্রোতের পাস কাটিয়ে নিজের মত এগিয়ে যায়। তারমধ্যেই দু এক কথা ওদের সঙ্গে যতটুকু হয়। সেটা নিয়ে আবার ভাবতে বসি। ভাবতে ভাবতে আবার অন্য ভাবনায় জড়িয়ে যাই। এভাবেই ভাবনায় ভেসে থাকি। ভাবনা অনেক রকম, কখনও রাত্রি বেলা অপিস ফেরতা বাড়ি যাওয়ার পথে, এখন বর্ষা কাল, গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল গাছে জল পড়লে ওদের গা থেকে কেমন একটা গন্ধ বেরোয়, জংলা গন্ধ, কথা থেকে এই গন্ধটা আসে? আবার মনে হয় এই গলিগুলো, রাস্তার মরা আলো গুলোয় ফেরার সময় রোজ কেমন যেন শৈশব উঁকি দেয়, মনে হয় পুরনো রাস্তা, পুরনো গলি, পুরনো বাড়ি এসবই আমার অনেক দিনের চেনা, রাস্তার পাশে একটু পুরনো বাড়ি দেখলে আমার ফেলে আসা বৃষ্টির জলে ধোওয়া স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটার কথা মনে পড়ে।
সেখান থেকে মনে হয় জানালা দিয়ে দেখা প্রত্যেকটা ঘরইতো কত গল্প, উপন্যাস, কবিতা, পুরনো বাড়ির ঝুলের মতো জমে আছে। কোন বাড়িতে আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, ছেলেটার চাকরি নেই, বাবার ক্যান্সার, কোনও চুপিচুপি প্রেম, ইশারা, কোনও জানলায় শুধুই উনুনের ধোঁয়া, চোখ জ্বালা করে। এগলি সেগলি দিয়ে যেতে যেতে দেখি কত বুড়ো বুড়ি কপাল চাপড়াচ্ছে, শরীর খুবলে বেরিয়ে ক্ষত-বিক্ষত ইট, বালি, চুন। পুরনো বাড়ির দাম নেই।জনসংখ্যা বাড়ছে, আশ পাশের গ্রামগঞ্জ থেকে ভীন রাজ্য থেকে মানুষ আসছে রুটি রুজির তাগিদে। ছাদের ব্যবস্থা এখনও করে উঠতে পারিনি। কি করেই বা করব? নামেই কর্পোরেট কম্পামির চাকরি। টাকা দেয় না। ঝকঝকে অফিস, এসি সবই আছে, অফিস দেখে সবাই আমাদের আমির ওমরা ভাবে, সম্মানও দেয়, কিন্তু আমি তো জানি এর সবটাই সাজানো, সন্ধেয় পাঁচ টাকার মুড়ি খেয়েই দিন কাটাতে হয়। খুব সামান্য অংশই মোটা বেতন পায়, বেশিরভাগেরই অবস্থা হরিপদ কেরানির। কর্পোরেট সংস্থাগুলো এভাবেই ক্ষুধার রাজ্যেও একটা মায়া জগৎ তৈরি করে।
সেখানে আমরা সবাই হাসি, নিজেকে রাজার সং সাজাই। আমি সেখানেও বেমানান, সং সাজতে পারিনা, হাততালি দিতে পারিনা, বেইমান, অসৎ, মেকি, মুখোশধারীদের সহয করতে পারি না। এটাও বুঝি, এসবই আমার বদ অভ্যাস, কিন্তু নিজেকে ভাঙতে পারিনা। এই যে এতকিছু পারিনা, এতকিছু মনের মধ্যে হয়, তাই বাঁ বলবো কাকে? সেরকম বন্ধুও তো পাইনা? অনেকে আবার এড়িয়ে চলে, কেউ খোরাক করে, সত্যবাদী যুধিষ্ঠির বলে গাল পাড়ে, কি করব কিছুই বুঝতে পারিনা, এই কয়েকদিন আগে টেলিভিশনে খুব রমরমিয়ে কঙ্কাল কাণ্ড চলল, এই শহরেরই একটা ঘরের ঘটনা, সেই ঘরের মধ্যে ছমাস ধরে কী চলছে, কেনই বা এরকম হল, কোন অবস্থায় মানুষগুলোর মনের রোগ ধরল? ধন, দৌলত, টাকা পয়সা ছিল, তবু সব ভেঙে চুরমার। সবথেকেও শেষ হয়ে গেল একটা পরিবার। এও দেখল শহর।
দেখল শহরের সাময-ভারসাম্য থাকা বহু মানুষ। অনেক প্রশ্নের উত্তরে মিলল আবার অনেক প্রশ্ন অন্ধকারেই থেকে গেল তিন নম্বর রবিনসন স্ট্রিটেই। একটা মানুষের বেঁচে থাকা কি নিয়ে, কেন বেঁচে থাকা, কার জন্যে বেঁচে থাকা, কিসের জন্য বেঁচে থাকা, এটা যদি কেউ স্পষ্ট করে তাঁর রোডম্যাপটা তৈরি করে নিতে পারে, তবে অস্তিরতা তৈরি হয়না। টাকা খুব দরকার ভাল করে বাঁচার জন্য। মনের ইচ্ছে পূরণের জন্য, আবার এটাও ঠিক টাকা থাকলেই সব ইচ্ছে পূরণ হয়না। সব আনন্দ পাওয়া যায় না। যেমন আজ থেকে বছর কুড়ি আগে স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে পাঁচ টাকার ঝাল মুড়ি কিনে খাওয়ার আনন্দ এখনতো আর পাই না। অফিসের টিফিন পিরিয়ডে এখনওতো সেই পাঁচ টাকার ঝাল মুড়ি খাই।