ডিয়ার জিন্দেগি : ভাইয়ুজি মহারাজের সুইসাইড নোটের মানে...
দয়াশঙ্কর মিশ্র
![ডিয়ার জিন্দেগি : ভাইয়ুজি মহারাজের সুইসাইড নোটের মানে... ডিয়ার জিন্দেগি : ভাইয়ুজি মহারাজের সুইসাইড নোটের মানে...](https://bengali.cdn.zeenews.com/bengali/sites/default/files/2018/06/13/124208-dear-zindagi-templatejune.jpg)
দয়াশঙ্কর মিশ্র
ভাইয়ুজি মহারাজ ছিলেন একজন 'মডেল' সন্ন্যাসী। ভোপালে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। সেই সময় আমি যে খবরের কাগজে কর্মরত ছিলাম, ভাইয়ুজি তার ম্যানেজিং ডিরেক্টরের অতিথি হয়ে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন। ভাইয়ুজি মহারাজ সেখানে পৌঁছনোর অনেক আগে থেকেই লোকজন তাঁর জন্য ফুল বিছিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। 'মহারাজে'র সেই অনুরাগী-অনুগামীদের তালিকা আশাতীত লম্বা। বলা হয়, প্রথম জীবনে তিনি ফ্যাশন ডিজাইনার এবং মডেল ছিলেন। এরপর সেই পথ ছেড়ে আধ্যাত্মিকতার নতুন রাস্তায় চলতে শুরু করেন তিনি এবং কালক্রমে আধ্যাত্মিক জগতের তথাকথিত 'হিরো' হয়ে ওঠেন। নামজাদা রাজনৈতিক নেতা থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, অনেকেরই আধ্যাত্ম চর্চার প্রয়োজন পড়ে। কারণ, জীবনের কোনও এক স্তরে তাঁদের আত্মবিকাশের প্রয়োজন হয়। তবে সেই আত্মবিকাশের বেশিরভাগটাই দেখনদারি। আদতে তাঁদের ভিতরে হয়তো এর কোনও অস্তিত্ব নেই।
ভাইয়ুজি মহারাজকে আমরা এমনই 'সেলিব্রিটি' সন্ন্যাসী বলতে পারি। যিনি সাধারণ মানুষের 'ক্লাস'-এ গিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার আগে নিজের 'ক্লাস'-এ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে জেনেছে অনেক পরে। সমাজে তাঁর উচ্চ অবস্থান, অনেক জনপ্রিয় লোকের ঈর্ষার কারণও হয়ে উঠেছিল। আসলে যেমন করেই হোক ভাইয়ুজি মহারাজ তাঁর চারপাশে একটি আলাদা জগত্ তৈরি করতে পেরেছিলেন। সেই পৃথিবীর নিয়ম-কানুন, আচার-আচরণ, ওঠা-বসা এক শ্রেণীর ধনী, প্রতিষ্ঠিত মানুষের কাছে 'গ্ল্যামারাস' বলেও বিবেচিত হত।
এমন একটা জগত্ গড়ে ফেলা মানুষ যখন নিজেকে শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন, তখন সেটা আর চমকে দেওয়ার মতো খবর থাকে না। বরং সেটা হয়ে যায় নাজেহাল করে দেওয়ার মতো খবর। 'ডিয়ার জিন্দেগি'র গত কয়েকটা লেখার মাধ্যমে আমরা দেখানোর চেষ্টা করছি কেমনভাবে ভারত, আমেরিকার মতো দেশগুলোয় আত্মহত্যা একটা জনপ্রিয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে! এখন এমন মানুষও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন, যাঁদের কাছে সেইসবকটি জিনিসই রয়েছে, সাধারণত যেগুলি না থাকার জন্যই মানুষ নিজেকে শেষ করার পথ বেছে নেয়।
আরও পড়ুন- সাম্বায় রাতভর প্রবল গোলাগুলি পাকিস্তানের, শহিদ ৪ বিএসএফ জওয়ান
ভাইয়ুজির সুইসাইড নোটের শেষ কয়েকটা কথা মনে করে দেখুন। ''আমি চললাম। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। নাজেহাল হয়ে পড়েছি।'' বেঁচে থাকার অন্তত হাজারটা কারণ রয়েছে। কিন্তু আত্মহত্যার মাত্র একটা। কেউ যদি সেই হাজারটা কারণ এড়িয়ে ওই একটা কারণকে বেছে নেয়, তা হলে আমাদের প্রথমে থামতে হবে। আর সমাজকে ঠিক ওই জায়গা থেকেই নতুন করে ভাবাতে বসতে হবে। বুঝতে হবে, বেঁচে থাকার জন্য সেই ব্যক্তি যে কারণগুলিকে বেছে নিয়েছিলেন, তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও 'ত্রুটি' রয়েছে। আর সে জন্যই বেঁচে থাকার একাধিক কারণ ছেড়ে একজন সেলিব্রিটিও মৃত্যুকে বেছে নেন।
অন্যকে সান্ত্বনা দিতে দিতে অনেক সময় আমাদের নিজের জন্য চোখের জলেই টান পড়ে। দুনিয়াজুড়ে 'তারকা'দের সঙ্গেও এমনই ব্যাপার-স্যাপার ঘটছে। আমেরিকার বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার কেট স্পেড ও জনপ্রিয় শেফ তথা ফুড ক্রিটিক ও লেখক এথনি বোরডেনের আত্মহত্যার খবরও এই তত্বকেই প্রতিষ্ঠা করে। গোটা বিশ্ব এই সব মানুষগুলোর সৃজনশীল কাজে সুখের খোঁজ করে। আর এঁরাই ছোট ছোট আনন্দ-খুশির সন্ধান করছেন। যে টুকরো টুকরো আনন্দ, খুশির মাধ্যমে নিজেকে সুখী রাখা যায়। আর তা আয়ত্তে না এলেই...
আরও পড়ুন- বিজেপি সরকারের চাপ নিতে না পেরেই ‘আত্মঘাতী’ ভাইয়ুজি মহারাজ?
'সব ঠিক হয়ে যাবে, খারাপ সময় ঠিক কাটিয়ে ওঠা যাবে', এরকম একটা ভাবনা কোনও এক সময় ভারতীয় জীবনশৈলির অঙ্গ ছিল। আর তাই সে সময় সম্ভবত এদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা এতটা বেশি ছিল না। অথচ জীবন তখন আরও কঠিন ছিল। তুলনায় জীবন এখন অনেক সহজ হয়েছে। তাই হয়তো আমাদের বেঁচে থাকাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একটাই কারণ। আমরা 'সব ঠিক হয়ে যাবে, খারাপ সময় ঠিক কাটিয়ে ওঠা যাবে'-এই তত্ত্ব থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছি।
স্বপ্নকে পাগলের মতো তাড়া করার মধ্যে কোনও ভুল নেই। উচ্চাকাঙ্ক্ষা শব্দটাও শুনতে খারাপ নয়। কিন্তু সেই স্বপ্ন, সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার রাশটা যতক্ষণ আমাদের হাতে থাকে, ততক্ষণই মঙ্গল। রাশটা আমাদের হাত থেকে পিছলে গেলেই কিন্তু জীবন উদভ্রান্তের মতো পথ হারিয়ে ফেলবে। বিপদের শুরু ঠিক সেখান থেকেই।
ভাইয়ুজি পরিবার, সম্পর্কের পাঠ পড়াতেন মানুষকে। কিন্তু আসলে নিজের জীবনের অর্থটাই অনেক আগে হারিয়ে ফেলেছিলেন স্বয়ং ভাইয়ুজি। যে কারণেই হোক তাঁর ভিতরে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। সেটার জন্য উনি হয়তো প্রচণ্ড কষ্টেও ছিলেন। জীবন, মনুষ্যত্ব সব ছেড়ে আমরা অনেক সময়ই নিজেদের দেখা স্বপ্নের পিছনে পাগলের মতো ছুটতে থাকি। সেই পাগলপারা দৌড়ই কিন্তু আমাদের দিনের শেষে জীবনের অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়।
কোনও কিছুর জন্য পাগল হয়ে উঠবেন না। কারও ভক্ত হয়ে ওঠারও প্রয়োজন নেই। বরং যেসব বন্ধুরা আপনার সহচর্য চায়, তাঁদের মধ্যেই জীবনের মানে খুঁজে নিন। এমন কারও মধ্যে মুক্তির পথ খুঁজবেন না যিনি নিজেই দিশাহারা নাবিক। এমন কারও মধ্যে আলোর খোঁজ করবেন না যে নিজেই অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। এখানে ক্লিক করে ব্লগটি হিন্দিতে পড়ুন
'ডিয়ার জিন্দেগি'র সবকটি ব্লগ পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন : 'ডিয়ার জিন্দেগি'
(লেখক জি নিউজের ডিজিটাল এডিটর)
(https://twitter.com/dayashankarmi)
আপনাদের প্রশ্ন ও মন্তব্য ইনবক্সে পাঠান- https://www.facebook.com/dayashankar.mishra.54
অনুবাদ- সুমন মজুমদার, জি ২৪ ঘন্টা ডিজিটাল।