"আমার মেয়ের নাম জ্যোতি সিং পান্ডে"
নির্যাতিতার নিজের পরিবারই প্রকাশ্যে এনেছেন তাঁর পরিচয়, এমন ঘটনা দেশ আগে দেখেছ বলে মনে পড়ে না। অবশ্য দেশ তো ধর্ষণ নিয়ে এমন বড় মাপের স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদও এর আগে দেখেনি। দিল্লির চলন্ত বাসে নারকীয় ঘটনার পর থেকে সময় যত এগিয়েছে তীব্রতর আকার নিয়েছে প্রতিবাদ। নির্যাতিতার জন্য সুবিধামতো নাম খুঁজে নিয়েছে ভারতের মিডিয়া।
নির্যাতিতার নিজের পরিবারই প্রকাশ্যে এনেছেন তাঁর পরিচয়, এমন ঘটনা দেশ আগে দেখেছ বলে মনে পড়ে না। অবশ্য দেশ তো ধর্ষণ নিয়ে এমন বড় মাপের স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদও এর আগে দেখেনি। দিল্লির চলন্ত বাসে নারকীয় ঘটনার পর থেকে সময় যত এগিয়েছে তীব্রতর আকার নিয়েছে প্রতিবাদ। নির্যাতিতার জন্য সুবিধামতো নাম খুঁজে নিয়েছে ভারতের মিডিয়া। কখনও আমানত, কখনও দামিনী, কখনও বা নির্ভয়া। এবার ভারতের মেয়ের আসল নাম প্রকাশ্যে আনলেন তাঁর বাবা। সোচ্চারে বললেন, "আমি চাই দুনিয়া আমার মেয়ের নাম জানুক- ওর নাম জ্যোতি সিং পান্ডে"। একটি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের মেয়ের নাম প্রকাশ্যে আনলেন তিনি।
উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার গ্রামের ৫৩ বছরের বদ্রি পান্ডে। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে তাঁর একমাত্র মেয়ে। মরতে মরতেও সারা দেশকে লড়াই করতে শিখিয়ে যাওয়া অদম্য সাহসী মেয়েটি সাহস জুগিয়ে গিয়েছে তার পৌঢ় বাবার মধ্যেও। যার জোরেই দিল্লি এয়াপোর্টে লোডারের কাজ করা নিম্নমধ্যবিত্ত এক বাবা আজ বলতে পারলেন, "আমার মেয়ে কোনও ভুল করেনি। নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে ওকে মরতে হয়েছে। আমি ওর জন্য গর্বিত। ওর নাম প্রকাশ্যে আনলে অন্য মহিলারা যাঁরা এই ধরণের পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তাঁরা লড়াই করার সাহস পাবেন। আমার মেয়ের মধ্যে তাঁরা লড়াই করার শক্তি খুঁজে পাবেন"।
মেয়ের মৃত্যুর পরই দিল্লির বাসস্থান ছেড়ে আপাতত বালিয়ার গ্রামের বাড়িতে পুরো পরিবারের সঙ্গে রয়েছেন বদ্রি। বাড়িতে থাকলেই যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেয়ের মুখ। ঘটনার পর থেকে বাকশক্তি হারিয়েছেন জ্যোতির মাও। মেয়ের নাম প্রকাশ্যে আনার সঙ্গেই ধর্ষকদের শাস্তিরও দাবি তুলেছেন বদ্রি। ছলছলে চোখ নিয়ে বললেন," প্রথমদিকে আমি অপরাধীদের নিজের চোখে দেখতে চাইতাম, কিন্ত এখন আর চাই না। আমি শুধু শুনতে চাই আদালত ওদের ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছে। ছ`জনের প্রাণদণ্ড চাই। ওরা নরখাদক। ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। যাতে সমাজে এরকম ঘটনা আর কোনওদিন না ঘটে।"
কথার ফাঁকেই সেই অভিশপ্ত রাতের কথাও বলেছেন বদ্রি। সেদিন রাতে সাড়ে দশটা নাগাদ কাজ থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। মেয়ে তখনও বাড়ি না ফেরায় দুশ্চিন্তায় বারবার জ্যোতি ও তাঁর বন্ধুকে ফোন করে যাচ্ছিলেন বদ্রির স্ত্রী। শেষপর্যন্ত সোয়া এগারোটায় হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে জানতে পারেন, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে মেয়ের। তড়িঘড়ি বন্ধুর মোটরবাইকে হাসপাতালে ছুটে যান বাবা। " প্রথম যখন জ্যোতিকে দেখি ও তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রয়েছে। চোখ বন্ধ। আমি ওর কপালে হাত রেখে নাম ধরে ডাকলাম। জ্যোতি চোখ খুলে আমাকে দেখেই কাঁদতে কাঁদতে জানাল খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। আমি কোনওমতে চোখের জল লুকিয়ে মেয়েকে সান্তনা দিয়েছিলাম, চিন্তা নেই। সাহস রাখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।" কথাগুলো বলার সময় কান্নায় বুজে আসছিল অসহায় বাবার গলা। মেয়েকে আশ্বাস দিলেও তখনও ধর্ষণের কথা জানতেন না বদ্রি। শেষপর্যন্ত পুলিসের কাছ থেকে শোনেন সেই ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ। কীভাবে বাসের ড্রাইভারের প্ররোচণায় জ্যোতি ও তাঁর বন্ধুকে অত্যাচার করেছে দুষ্কৃতীরা, দিল্লি বিমানবন্দ, যেখানে তখনও কাজ করছিলেন বদ্রি, সেখান থেকে অল্প কিছু দূরেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বাস থেকে।
ঘটনার ১০ দিন পর্যন্ত বদ্রি আশা করেছিলেন বেঁচে যাবে তাঁর মেয়ে। কোনও মতে কান্না চেপে জানালেন, "চিকিত্সকরা সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। আমার মেয়ে বেশ কয়েকবার হাত পা নেড়ে কথা কথা বলার চেষ্টাও করছিল। গলায় নল ঢোকানো থাকায় ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সব কষ্টের মধ্যেও কাগজে লিখে জানিয়েছিল, ও বাঁচতে চায়। আমাদের সঙ্গে থাকতে চায়। কিন্তুর ভাগ্যের পরিণতিতে ওকে শেষপর্যন্ত চলে যেতে হল"।
মৃত্যুর আগে দু`বার পুলিসের কাছে বয়ান দিয়েছিলেন জ্যোতি। বদ্রি বলেন, "বয়ান দেওয়ার সময় আমার স্ত্রী জ্যোতির সঙ্গে ছিলেন। বয়ান শোনার পরই উনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে উনি আমাকে পুরো ঘটনা জানিয়েছিলেন। আমি সত্যিই সেটা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। শুধু এটুকুই বলতে পারি, ওরা মানুষ নয়। পশুও নয়। এই পৃথিবীরই কেউ নয়। আমি চাই আর কারও সঙ্গে এরকম ঘটনা না ঘটুক। আমার মেয়ে অনেক কেঁদেছে। ও খুব কষ্ট পেয়েছ। মা ও ভাইদের দেখার সঙ্গে সঙ্গেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু আমার মেয়ে সত্যিই খুব সাহসী ছিল। ওই অবস্থাতেও আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে। বলে গেছে, সব ঠিক হয়ে যাবে"।
অত্যাচারের পর জ্যোতির অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিল যে অন্ত্রের অংশ বাদ দিতে চিকিত্সকরা বাধ্য হয়েছিলেন। তাতেই শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। শেষ চেষ্টা করতে সিঙ্গাপুরে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জ্যোতিকে। কিন্তু তখনও মনের জোর হারাননি জ্যোতি। সেই মুহূর্তের কথাও বলেছেন বদ্রি। "আমি ওকে বলেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসব। বাড়ি ফেরার কথা শুনে জ্যোতি খুশি হয়েছিল। হেসেওছিল। আমি ওর কপালে হাত রেখেছিলাম। জ্যোতি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি খেয়েছি কি না। তারপর আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। আমি হাত ধরে চুমু খেয়ে বলেছিলাম চিন্তা করো না, বিশ্রাম নাও। জ্যোতি নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করেছিল", ইঁটের দেওয়ালের বাড়িতে লম্ফর আলোয় বসে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন অসহায় বাবা। লড়াইয়ের সেই বিভীষিকাময় তেরো দিন দিল্লির রাস্তা ফেটে পড়েছিল প্রতিবাদে। যার থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন বদ্রি। "আমি চেয়েছিলাম ও বেঁচে যাক। যদিও জানতাম এই ক্ষত ওকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আমাদের পুরো জগতটাই ছিল জ্যোতিকে ঘিরে। ওর মাকে জ্যোতি জানিয়েছিল কীভাবে অয়ীন্দ্র ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুষ্কৃতীরা তাকে ক্রমাগত রড দিয়ে মেরেই চলছিল"। চরম অসহায়তার মধ্যেও সারা দেশকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি বদ্রি। "গোটা দেশ আমাদের লড়াই করতে সাহস জুগিয়েছে। এখন আর ও আমার একার মেয়ে নয়, সারা দেশের সন্তান। বদ্রি মনে করেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া পুলিসের একার কাজ নয়। সবার আগে বাবা মায়েদের শেখাতে হবে মহিলাদের সম্মান করতে", শেষ কথাগুলো বলার সময় যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন বদ্রি। জ্যোতির মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও এখনও মেয়ের কথা ভাবলেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাবার মুখ। হাসিখুশি স্বভাবের মেয়েটি পাশ্চাত্য পোশাকেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিল। লম্বা, কালো চুল খুলে রাখতেই পছন্দ করত জ্যোতি। ডাক্তার হতে চেয়েছিল সে। মাত্র ৫,৭০০ টাকা মাসিক আয় থেকে টাকা বাঁচিয়েও তার পড়োশোনার খরচ চালাচ্ছিলেন বদ্রি। দুই ছেলে থাকা সত্ত্বেও, উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও মেয়ে হিসেবে কোনওদিনও তাকে অবহেলা করেননি বাবা। সেখান থেকেই হয়তো লড়াই করার অদম্য সাহস পেয়েছিল জ্যোতি। তবে বাবা তাকে বাঁচাতে পারেননি দুনিয়ার অবহেলার হাত থেকে।