পর্যটনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাইল্যান্ড

থাইল্যান্ড। কয়েক বছর আগেও দেশটার নাম কজন ট্যুরিস্টই বা জানতেন? কিন্তু এখন বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রের অন্যতম কেন্দ্র। কলকাতা তো বটেই পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষও এখন বেড়াতে যাচ্ছেন থাইল্যান্ডে। দেশটার অর্থনীতিই দাঁড়িয়ে আছে পর্যটনের উপর। স্রেফ পর্যটনের উপর ভর করে কীভাবে একটা দেশের অর্থনীতি চলতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

Updated By: Aug 16, 2013, 10:00 PM IST

থাইল্যান্ড। কয়েক বছর আগেও দেশটার নাম কজন ট্যুরিস্টই বা জানতেন? কিন্তু এখন বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রের অন্যতম কেন্দ্র। কলকাতা তো বটেই পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষও এখন বেড়াতে যাচ্ছেন থাইল্যান্ডে। দেশটার অর্থনীতিই দাঁড়িয়ে আছে পর্যটনের উপর। স্রেফ পর্যটনের উপর ভর করে কীভাবে একটা দেশের অর্থনীতি চলতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
বলিউড, টলিউড এবং দক্ষিণী সিনেমার সৌজন্যে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে থাইল্যান্ড এইমূহুর্তে অন্যতম পছন্দের জায়গা এদেশের মানুষের কাছেও। গোয়া, কাশ্মীর, সিমলা, কুলু, মানালির বদলে কম খরচে বিদেশ বেড়ানোর স্বাদ পেতে থাইল্যন্ডের ব্যাঙ্কক, পাটায়া, ফুকেতে ছুটছেন ভ্রমণ পিপাসু বাঙালিও।  থাই-রয়্যাল সরকারের পর্যটন দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, দুহাজার বারো সালে থাইল্যান্ডে ঘুরতে আসা মোট বিদেশি পর্যটকের প্রায় তিরিশ শতাংশই ভারতীয়।
থাই এয়ারওয়েজ কিংবা এয়ার এশিয়ার বিমানে মাত্র পৌঁনে তিন ঘণ্টার জার্নি। কলকাতা থেকে সরাসরি ব্যাঙ্ককের ডন মুয়াং ইন্টারন্যানাল এয়ারপোর্ট। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মিটিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে পা রাখলেই মনে হবে পৌঁছে গেছেন ইউরোপের কোনও শহরে। ঝকঝকে রাস্তা, ঝাঁ-চকচকে আকাশছোঁয়া বহুতল। গন্তব্য ঠিকঠাক জানা থাকলে চড়ে বসতে পারেন ব্যাঙ্ককের লাইফলাইন মনোরেলে। নাহলে মিটার ট্যাক্সি তো আছেই। ট্যাক্সিতে উঠলেই ভাড়া পঁয়ত্রিশ ভাট। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সত্তর টাকা। আর আছে টুকটুক। অটোরিকশাকে ওখানে ডাকা হয় টুকটুক নামে। দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া ঠিক করে টুকটুকে  চড়ে বসতে হয়।  
 মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে অসংখ্য উড়ালপুল। রাস্তার একটি লেন, কলকাতার রেড রোডের প্রায় দুটি লেনের সমান চওড়া। এটাই ব্যাঙ্কক। তবে কলকাতার সঙ্গে মিল আছে অন্তত একটা জায়গায়। যানজট। যানজটে বোধহয় কলকাতাকে টেক্কা দেয় ব্যাঙ্কক। ট্রাফিক জ্যামে আটকে গিয়ে কলকাতার কথা মনে পড়তে বাধ্য।  ব্যাঙ্ককের বুক চিরে বয়ে গেছে চাও-ফ্রায়া নদী। ট্র্যাফিক জ্যাম এড়িয়ে, রাতের মায়াবি আলোয় জলপথে শহরটাকে ঘুরে দেখতে চাইলে চড়ে বসতে পারেন রিভার ক্রুজে। খরচ সাধ্যের মধ্যেই। উপরিপাওনা প্রমোদ তরীর রঙিন বিনোদন।

বিদেশীদের কাছে ব্যাঙ্ককের অন্যতম ইউএসপি শহরটার নিশিজীবন। রাত যত বাড়ে ততই রঙিন হয় ব্যাঙ্কক। শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ডান্স বার, ডিস্কো থেক। সর্বত্রই বিদেশি পর্যটকদের উপচে পড়া ভীড়। তবে শুধুমাত্র ডিস্কো থেক বা ডান্স বার নয় থাই, কোরিয়ান, জাপানিস, ইটালিয়ান, ফরাসী, ভারতীয় সব ধরণের রেস্তোরাঁতেই আছে বিনোদনের ঠাসা প্যাকেজ। ব্যাঙ্ককের ফুটপাথের অন্যতম আকর্ষণ স্ট্রিট ফুড স্টল। দু-পা অন্তর চোখে পড়বে হরেক রকমের থাই-ফুডের পসরা। আগে থাই ফুড চেখে দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলে কিন্তু একটু সামলে। কারণ, চিংড়ি, জায়ান্ট ক্র্যাব, চিকেন, হাঁসের রোস্ট, চেনা-অচেনা সামুদ্রিক মাছের হরেক প্রিপারেশন তো আছেই। পাশাপাশি মেনুতে হাজির স্টার ফিস, ব্যাঙ, ঝিনুক, শামুক, বেবি অক্টোপাস, কাঁকড়াবিছে, সাপ এমনকি  ফড়িংও। ঠিকঠাক খাবার চিনতে না পারলে সমস্যায় পড়তে পারেন। কারণটা ভাষা। বেশির ভাগ স্ট্রিট ফুড বিক্রেতাই ইংরেজি জানেন না। তবে মন চাইলে নতুন ফুড আইটেম পরখ করে দেখতেই পারেন।
ব্যাঙ্কক ছাড়িয়ে পাটায়া যাওয়ার পথে পড়ে সিচিরা টাইগার জু। সাধারণ চিড়িয়াখানার সঙ্গে এই জু-এর কিছুটা পার্থক্য আছে। এর মূল আকর্ষণ TIGER RESTURANT। এক্কেবারে বাঘের সঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ সারার অভিজ্ঞতাটা নিয়ে নিতে পারেন। পাঁচিল ঘেরা চওড়া মাঠ, জলাশয়। ঘেরা জায়গার মধ্যে কংক্রিটের পিলার আর প্লাটফর্মের ওপর রেস্তোরাঁ। মাটি থেকে মাত্র তিন ফুট ওপরে। গোটা রেস্তোরাঁটি ঘেরা বুলেটপ্রুফ কাচে। যেকোনও সময় কৌতুহলি বাঘের থাবা এসে পড়তে পারে আপনার লাঞ্চ টেবিলের কাচের দেওয়ালে।
 
ব্যাঙ্কক শহর থেকে একশো বারো কিলোমিটার। পাহাড়, সমুদ্র ঘেরা ছোট্ট শহর পাটায়া। শহর ছোট হলেও, এর আকর্ষণ অপরিসীম। শহর ঘুরে দেখার জন্য ট্যাক্সি, টুকটুক তো আছেই। সামান্য খরচে মোটর  বাইক ভাড়া করেও ঘুরে দেখতে পারেন পাটায়া সিটি। শহরের ঠিক মাঝামাঝি অ্যালকাজার স্কোয়্যার। পাটায়ায় এসে এখানে না এলে অনেক কিছুই মিস করবেন। ক্যাবারে-শোয়ের জন্য বিখ্যাত এই অ্যালকাজার স্কোয়্যার। অ্যালকাজার থিয়েটারে দেড় ঘণ্টার অভিনব ক্যাবারে  শো। চোখ ধাঁধানো কোরিওগ্রাফি। এই ক্যাবারে শো-এর মূল বৈশিষ্ট্য, যারা পারফর্ম করছেন তাঁরা সকলেই শী-মেল। শো-এর টিকিটের চাহিদা আকাশছোঁয়া। আগে থেকে বুকিং না থাকলে টিকিট মেলা দুষ্কর। ফ্লোটিং মার্কেট। পাটায়ার অভিনব শপিং সেন্টার।  ছিপ নৌকায় জলের অলিগলি পেরিয়ে বাজার করার হাতেগরম এক্সপেরিয়েন্সটা কিন্তু বেশ জমজমাট।
 
সমুদ্র সৈকত লাগোয়া পাটায়ার বিচ রোড। রাস্তার গায়ে আছড়ে পড়ছে ভারত মহাসাগরের  ঢেউ। অ্যাডভেঞ্চার চান? আছে প্যারাগ্লাইডিং, সী-বাইক, স্কুবা ড্রাইভিং। মিলবে সব কিছুই।  আবহাওয়া অনুকূল থাকলে স্পিড বোট ভাড়া করে পাটায়া ছেড়ে ভেসে পড়তে পারেন সমুদ্রেও। পাটায়া থেকে এক মাইল দূরে সমুদ্রের ওপর ভাসমান জেটি পালাচোট। কোরাল আইল্যান্ডে যেতে হলে এই জেটি ছুঁয়ে যেতে হয়। পাটায়া থেকে ছোট স্পিড বোট পৌঁছে দেয় পালাচোট জেটিতে। মূলত প্যারাগ্লাইডিংয়ের জন্য বিখ্যাত এই জেটি। পালাচোট থেকে কোরাল আইল্যান্ডের দূরত্ব আরও প্রায় ছ-মাইল। কোরাল আইল্যান্ড যেতে হলে এখান থেকে বদল করতে হয় স্পীড বোট। কারন সামনে উত্তাল সমুদ্র। ছোট স্পীড বোটে  সেখানে পৌঁছন কার্যত অসম্ভব।

পাটায়া থেকে স্পীড বোটে কোরাল আইল্যান্ডে যাওয়ার খরচ ২ হাজার ভাট। অর্থাত্ প্রায় চার হাজার টাকা। তবে এই জার্নি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সমুদ্রের নীলচে-সবুজ স্বচ্ছ জল আর সাদা বালিয়াড়ি মিলিয়ে  এক অদ্ভুত সুন্দর জায়াগা এই কোরাল আইল্যান্ড। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য় ছাড়াও এখানে আছে আরও অনেক কিছু। গভীর সমুদ্রের অজানা জগতটাকে চোখের সামনে দেখতে চান? সাঁতার জানার কোনও দরকারই নেই। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে সমুদ্রের তিরিশ মিটার গভীরে নেমে পায়ে হেঁটেই ঘুরে দেখতে পারেন অচেনা জগতটাকে। সমুদ্রে পনেরো মিনিট স্কুবা ড্রাইভিংয়ের খরচ মাত্র আটশো ভাট। সবুজ পাহাড় ঘেরা কোরাল আইল্যান্ড বা প্রবাল দ্বীপের সব জায়গায় অবশ্য পর্যটকদের এন্ট্রি নেই।  দ্বীপের একটা বড় অংশ সংরক্ষিত শুধু  রাশিয়ার পর্যটকদের জন্য। ওটা রাশিয়ানদের  প্রাইভেট  বিচ। অন্য কোনও দেশের নাগরিকদের সেখানে নো-এন্ট্রি। থাই রয়্যাল গভর্নমেন্টের সঙ্গে রাশিয়ার  এ-এক অলিখিত চুক্তি।  
কোরাল আইল্যান্ডের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই আছে আরও দু-টি প্রবাল দ্বীপ। সাক এবং ক্রুক আইল্যান্ড। ক্রুক আইল্যান্ডে যাওয়ার ক্ষেত্রে  সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে। এই ক্রুক আইল্যান্ড নাকি থাইল্যান্ডের এক প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত দ্বীপ।  দ্বীপটি নাকি বছর তিরিশ আগে কিনে নেন তিনি। এখন তাঁর পরিবারের লোকেরাই দ্বীপটির মালিক। এমন কথা শোনা যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে। সাক আইল্যান্ড অবশ্য পর্যটকদের জন্য খোলা। তবে  খুব বেশি পর্যটক সাক আইল্যান্ডে যান না। দূরত্ব এবং উত্তাল সমুদ্রের  মুডের জন্যই সাক আইল্যান্ডে ট্যুরিস্ট নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে যান গাইড ও স্পীড বোট চালকরা। কোরাল আইল্যান্ডে ঘুরতে এসে, সতর্ক না থাকলে  কিন্তু বিপদ।  যেমন সি-বাইকিং। সি-বাইক ভাড়া  নেওয়ার আগে অগ্রিম টাকা এবং পাসপোর্ট জমা দিতে হয় বাইক মালিককে। এখানেই পাতা আছে  প্রতারণা চক্রের ফাঁদ। স্থানীয়দের কাছে এদের পরিচয় বাইক মাফিয়া হিসেবে। একবার খপ্পরে পড়ে গেলে মাফিয়াদের দাবি মতো টাকা না দিয়ে  রেহাই পাওয়ার জো নেই। পাটায়া শহর থেকে বহু দূরে সমুদ্রের মাঝে, এই পরিস্থিতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেলে না পুলিসের সাহায্য। এমনটাই জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।  
 
দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য শুধু কোরাল আইল্যান্ডে নয়। বিশ্বের অন্যতম ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হওয়ায় দিনকে দিন ড্রাগ মাফিয়া এবং দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে ব্যাঙ্কক, পাটায়া। তাই, পর্যটকদের জন্য স্থানীয় গাইডদের পরামর্শ, সামলে রাখুন নিজের পাসপোর্ট এবং পকেট। বিপদ আসতে পারে  যেকোনও সময়ে।  রাতে পায়ে হেঁটে ব্যাঙ্কক, পাটায়ায় ঘুরতে হলে  সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা রাখবেন না। এমনটাই পরামর্শ, স্থানীয় পুলিস এবং গাইডদের। অর্থাত্ ব্যাঙ্কক এ নাইস সিটি। কিন্তু ব্যাঙ্ককে সাবধান।     

.